কর্তৃপক্ষ চেয়েছিলেন, কারখানা চালাতে সরকারি সাহায্য। রাজ্য সরকারের বক্তব্য, ‘আগে কারখানা খুলুন, পরে আলোচনা।’
ডানলপের সাহাগঞ্জ কারখানায় লকআউট নিয়ে সোমবার মহাকরণে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন সংস্থা কর্তৃপক্ষ। এই আলোচনার জন্য চারটি বিষয় আগে থেকে নির্ধারিত থাকলেও, মূলত কথা হয়েছে সংস্থার নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে সরকারি সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই।
আলোচনার টেবিলে পবন রুইয়ার সংস্থার দাবি, কারখানা চালানোর মতো পুঁজি এই মুহূর্তে তাদের হাতে নেই। বিশেষত কারখানা বন্ধ থাকার সময়ের বকেয়া প্রায় ১৩ কোটি টাকা বিদ্যুতের বিল মেটানোর দায় তাদের কাছে বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে উঠেছে। তাই এই পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট’ (নিজেদের ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র) গড়তে চায় তারা। যাতে কারখানা চালাতে বিদ্যুতের খরচ কমে। সেই সঙ্গে ‘অতিরিক্ত’ বিদ্যুৎ গ্রিডে দিয়ে আয়ের রাস্তা পাকা করতে পারে সংস্থা। কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে মুখ না-খুললেও অনেকেই মনে করছেন যে, এর ফলে প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়াবে কারখানায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের খরচ। সংস্থা চায়, এ বিষয়ে তাদের আর্থিক সহায়তা দিক রাজ্য সরকার। |
কিন্তু সেই দাবি এ দিন কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছে রাজ্য। তাদের স্পষ্ট অবস্থান আগে কারখানার দরজা খুলুক, তার পর এই নিয়ে আলোচনা। একই সঙ্গে, আর্থিক সাহায্য দিয়ে বেসরকারি সংস্থা চালানোর দায় যে সরকারের নয়, এ দিন তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছে রাজ্য।
তবে সংস্থার কর্মীদের একাংশের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে এবং কারখানা খুলে রাখা যাচ্ছে না বলে কর্তৃপক্ষের তরফে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে রাজ্য সরকার।
পুজো মিটতেই ডানলপের সাহাগঞ্জ কারখানায় ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’-এর নোটিস পড়ে গত শনিবার। এ নিয়ে সোমবার মহাকরণে দুপুর একটায় কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। সেখানে ডানলপের তরফে উপস্থিত ছিলেন সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর সমীরকুমার পাল, সাহাগঞ্জ ইউনিটের প্রধান এম এ খান এবং কর্পোরেট কমিউনিকেশন্সের দুই কর্তা সুজিত রায় এবং উষা মেনন বসু।
কিন্তু এই বৈঠকে কেন নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির উপর এত জোর দিয়েছে রুইয়া গোষ্ঠীর এই সংস্থা?
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সাহাগঞ্জ কারখানাকে প্রায় গোড়া থেকেই তাড়া করে ফিরছে বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যা। ছাবরিয়া গোষ্ঠীর কাছ থেকে এই কারখানা কেনার পর রুইয়া জানিয়েছিলেন, তাঁরা কেনার আগে রুগ্ণ অবস্থায় পড়ে থাকার সময় ওই কারখানার বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। কারখানা বন্ধ থাকার সময় কী ভাবে ওই বিপুল টাকার বিদ্যুৎ খরচ হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁরা। কোনও ভাবেই নিতে চাননি ওই টাকা মেটানোর দায়ও। এ নিয়ে পূর্বতন বাম সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনও শুরু হয়েছিল তাদের।
এর পর বাম জমানার প্রায় শেষের দিকে শেষ পর্যন্ত কয়েক কিস্তিতে ওই টাকা মিটিয়ে দিতে রাজি হয় সংস্থা। কিন্তু প্রায় একই সঙ্গে প্রস্তাব দেয় সংস্থার নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হলে, তার ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের (ডব্লিউবিএসইডিসিএল) গ্রিডে দিতে পারবে ডানলপ। ওই কেন্দ্রে ইউনিট-পিছু বিদ্যুৎ তৈরির খরচ কত, তা নির্ধারণ করবে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। পর্ষদ রাজি হলে ওই খরচের সঙ্গে আরও ১৭ শতাংশ অতিরিক্ত ধরে নির্ধারিত দামে তা গ্রিডে দিতে পারবে সংস্থা। এই সব ক্ষেত্রে সাধারণত যা লাভজনক হয় সংস্থার পক্ষে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এই ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট’ গড়তে পারলে এক দিকে কারখানায় ব্যবহৃত বিদ্যুতের খরচ এক ঝটকায় অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে পারবে ডানলপ। একই সঙ্গে, তৈরি করে ফেলতে পারবে আয়ের পাকা রাস্তাও। যে কারণে রুইয়ার সংস্থা ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির উপর এত জোর দিচ্ছে বলে মনে করছে তারা।
তা ছাড়া, সাহাগঞ্জ কারখানার গায়ে ‘রিলিফ আন্ডারটেকিং’-এর তকমার মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছে গত বছরই। এই সুবিধা থাকলে, পাওনাদাররা মামলা করলেও, সংস্থা গুটিয়ে সেই টাকা মেটাতে বাধ্য হন না কর্তৃপক্ষ। তাই ওই তকমা ফিরে পেতেও এ দিন রাজ্য সরকারের কাছে দরবার করেছেন সংস্থার প্রতিনিধিরা। অভিযোগ জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও।
প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠকের পর সমীরবাবুর অভিযোগ, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হয়েছে। কারখানাকে কেন্দ্র করে গুণ্ডামি হচ্ছে। কর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভাঙা হচ্ছে দরজা-জানালা। বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে ইট। এ সব প্রশাসনকে বার বার জানানো হয়েছে। এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও পদক্ষেপ করেনি প্রশাসন।” তাঁর কথায়, “বন্দুকের নলের সামনে কারখানা চালানো যায় না। তাই এটা কারখানা বন্ধের অন্যতম কারণ।”
এর জবাবে শিল্পমন্ত্রী বলেন, “ওঁরা আইনশৃঙ্খলার কথা বলেছেন। সেটা আমরা দেখে নেব। প্রয়োজনে কঠোর হবে সরকার। কিন্তু ওঁদের বলেছি যে, এতে কি কারখানা বাঁচবে? ১০ মাস ধরে তো কোনও উৎপাদনই হচ্ছে না।” তিনি জানান, কর্তৃপক্ষকে বলেছি যে আপনাদের অন্যান্য কারখানা তো ভাল চলছে। তা হলে এখানে এমন দুরবস্থা কেন? জেসপ-এর অবস্থাও তো খুব খারাপ। রাজ্য সরকারকে কিছু না জানিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার এই ঘটনা যে তাঁরা ভাল চোখে দেখেননি, তা-ও ডানলপের প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে পার্থবাবুর দাবি।
ডানলপের প্রতিনিধিরা জানান, কারখানায় মূলত চারটি সমস্যা রয়েছে
l আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি।
l সাহাগঞ্জের জমিতে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব পরিবেশ দফতরের সম্মতির অপেক্ষায় দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা।
l সংস্থার আধুনিকীকরণের জন্য কার্যকরী মূলধনের সমস্যা।
l কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কাজ এখনও বাকি থাকা।
সমীরবাবু বলেন, “পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের জন্য বিস্তারিত রিপোর্ট (ডিপিআর) শীঘ্রই জমা দেব আমরা। এ বিষয়ে আমরা রাজ্য সরকারের সাহায্য চাই।”
এ প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রী অবশ্য স্পষ্ট জানান, “ওঁরা আর্থিক সমস্যার কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা বলেছি, আগে কারখানা খুলুন। শ্রমিকদের আস্থা ফেরান। ওঁরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কথা বলছেন। সে বিষয়ে আমরা বলেছি, অন্য জায়গা থেকে টাকা আনুন। পুনরুজ্জীবন কী করে করা হবে, সেটা কারখানার পরিচালন পর্ষদ দেখুক। আর কার্যকরী মূলধন জোগাতে হলে তো কারখানার গায়ে অশোক স্তম্ভ লাগাতে হবে।” ২০০৬ সালে রুইয়া গোষ্ঠীর হাতে আসার পরও টানা সে ভাবে কখনওই চাকা ঘোরেনি ডানলপের সাহাগঞ্জ কারখানায়। তাই কোনও কোনও মহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে, তা হলে কি লক্ষ্য শুধু কারখানার জমি? এ বিষয়ে পার্থবাবুর দাবি, “ওঁদের বলে দিয়েছি, শিল্পের জমিতে শিল্পই করতে হবে।” |