প্রবন্ধ ২...
মেয়েরাই শান্তির দূত?
ঘরে এবং বাইরে?
বারে নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপক তিন জন-ই নারী। দু’জন গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত লাইবেরিয়ার পুনর্গঠনে নারীশক্তির পুরোধা বলে চিহ্নিত: লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন-সারলিফ (৭২) আর লেমা জিবোউই (৪২), শেষ জন আরবি বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠ মেলানো ইয়েমেনের সাংবাদিক তাওয়াকুল কারমান (৩২)। অন্য কোনও বিষয়ে নয়, এ পর্যন্ত নোবেলজয়ী হিসেবে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন শান্তি পুরস্কার। পরিবারে তো বলাই হয়, মেয়েদের হাতে নাকি থাকে শান্তির চাবিকাঠি। তা হলে কি ঘরে নয় শুধু, বাইরেও শান্তির দূত মেয়েরাই? অনেকের বক্তব্য মেয়েরা আসলে মায়ের জাত, গর্ভধারিণী। তাই সৃষ্টির মর্ম অনেক বেশি বোঝে বলেই তারা ধ্বংসের বিরুদ্ধে, হত্যার বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে। মেয়েরা গর্ভধারিণী বলেই শান্তির মর্ম অনেক গভীর ভাবে বোঝে, এই শান্তি পুরস্কার তারই স্বীকৃতি?
রাষ্ট্রপুঞ্জ বা নোবেল কমিটির যুক্তি অবশ্য ঠিক সে রকম নয়। যুদ্ধ বা সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পৌরুষ নিয়ে আমাদের চলতি ভাবনা। সেখানে পৌরুষ মানে অন্যকে বাধ্য করা, জোর করে কাজ করানো, প্রতিযোগিতা, নিজের পদ সম্বন্ধে সচেতন থাকা এবং অন্যকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া। আমাদের চার দিকের প্রতিষ্ঠানগুলি পুরুষপ্রধান বলে সেখানে প্রাধান্য পায় প্রতিযোগিতা, সংঘর্ষ সহযোগিতা বা আলোচনা নয়। মেয়েরা সাধারণ ভাবে শাসিত বলেই তারা আগ্রাসী ভাবে এগোয় না, নেগোসিয়েশন বা আলোচনায় তারা অনেক বেশি সফল, সফল সহযোগিতাতেও। প্রাথমিক ভাবে মেয়েরাই পরিবারের দেখভালের দায়িত্বে থাকে বলে বাইরে যুদ্ধ বা সংঘর্ষ বাধলে মেয়েরা আর শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ক্ষতি নানা চেহারায় আসতে পারে রোজগারের উৎসে টান পড়া, ঘরের মানুষদের প্রয়োজন মতো আর সময় মতো খাবার দিতে না পেরে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হওয়া, সময় মতো পালাতে না-পারা, যৌন নিগ্রহ আর যৌন দাসত্বের শিকার হওয়া।
তাওয়াকুল কারমান লেমা জিবোউই আলেন জনসন-সারলিফ
আর আমাদের চার দিকের প্রতিষ্ঠানগুলিতে, তা সে রাষ্ট্র হোক বা নিরাপত্তার নানা আয়োজন, সেনাবাহিনী থেকে পুলিশ বা ব্যক্তিগত রক্ষিবাহিনী, পুরুষদেরই প্রাধান্য। সেখানে যে যত বেশি আগ্রহী, ধরে নেওয়া হবে সে তত বেশি সফল। আলোচনা বা সহযোগিতাকে ধরা হয় ‘ভীতু’র লক্ষণ বলে, মেয়েলি বলে। তবে, যেমন সব পুরুষই যে ব্যক্তিগত ভাবে সব সময় আগ্রাসী হবেন তা বলা হচ্ছে না। এখানে বলা হচ্ছে পৌরুষ আর নারীত্বের চলতি মাপকাঠির কথা, যা ওই ভূমিকা নিতে না চাইলে পুরুষকে চিহ্নিত করে ‘মেয়েলি’ বলে আর বহু সময় অগ্রণী মেয়েদের বলে ‘পুরুষালি’। নোবেল কমিটি আর রাষ্ট্রপুঞ্জের যুক্তি, আরও বেশি সংখ্যায় মেয়েরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় এলে চলতি সাফল্যের মাপকাঠি, পুরুষের সংস্কৃতি কোথাও ধীরে ধীরে পিছু হঠবে, ঠাঁই পাবে ধীরে ধীরে এক মানুষের সংস্কৃতি যা বলে, নেতৃত্ব মানে শুধু আগ্রাসী হওয়া নয়, আলোচনা, দরাদরিতেও দক্ষ হওয়া।
নোবেল শান্তি পুরস্কার মানেই বিতর্ক। এলেন জনসন-সারলিফ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির কৃতী ছাত্রী, এক সময়ে লাইবেরিয়ার অর্থমন্ত্রীও ছিলেন, তার পর গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে জেলেও যান, দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কে যোগ দেন। গৃহযুদ্ধের শেষে ফিরে এসে নির্বাচনে লড়ে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট। এক জন কড়া প্রশাসক হিসেবে পরিচিত ও বিভিন্ন সম্মানে সম্মানিত হলেও তাঁর শাসন নিয়ে সমালোচনাও অনেক। আগামী বছরে নির্বাচনের আগে এই পুরস্কার লাইবেরিয়াতে বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। লাইবেরিয়া দেশটি তৈরিই হয়েছিল মুক্ত হওয়া দাসদের জন্য। কিন্তু সেখানে নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত খ্রিস্টান, মুসলিম আর দেশজ ধর্মের মানুষদের মধ্যে বাধে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে মেয়েরা হচ্ছে অন্যতম শিকার। এক গোষ্ঠীর পুরুষরা অন্য গোষ্ঠীর মেয়েদের ওপর যথেচ্ছ যৌন নিগ্রহ চালায়, সে ভাবেই যে অন্য গোষ্ঠীর পুরুষদের মুখে সবচেয়ে বেশি চুন-কালি মাখানো যাবে, সবচেয়ে বেশি অপমান করা যাবে। এর বিরুদ্ধে প্রথমে খ্রিস্টান মেয়েদের নিয়ে শান্তি আন্দোলন শুরু করে সব ধর্মের সব গোষ্ঠীর মানুষদের এক করেন জিবোউই। গান বেঁধে মেয়ে আর শিশুদের রক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করান আর জড়ো করেন তাঁর সংগঠন ‘উইমেন ফর পিস’-এর ছাতার তলায়। অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে নানা পথ নিত তাঁর মেয়েরা, এমনকি ‘যৌন হরতাল’ও। লেমা জিবোউই লুথারিয়ান চার্চের এক শাখার সভাপতি, তাঁর কাজের জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার ইতিমধ্যেই পেয়েছেন।
আরবি বসন্তে সামিল মিশর-সিরিয়া-তিউনিসিয়া-বাহরেইন-লিবিয়া। ইয়েমেনের গায়ে এখনও পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি। লোকে বলে নোবেল শান্তি পুরস্কার আসলে একটা রাজনৈতিক পুরস্কার। কোন রাজনীতিটা পশ্চিমের চোখে কাম্য, তার ইশারায় স্থির হয় প্রাপকের নাম। তাই চিনের বিরুদ্ধে অর্থনীতির যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে তার গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে পশ্চিম রায় দেয় দলাই লামা বা হু জিয়াবাওকে পুরস্কার দিয়ে। আরবি বসন্তের কেউ-না-কেউ নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবেন, সে আন্দাজ ছিলই। মিশরের আসমা মেহফুজ বা ইসরা আবদেল ফাতা অথবা তিউনিসিয়ার লিনা বেন মেহন্নির নামও ছিল সেই দৌড়ে। সুইডেনের কবি সারা জীবন কবিতা লিখে আশি বছর বয়সে সাহিত্যে নোবেল পেলেন, আর সদ্য আন্তর্জাতিক নজরে আসা বত্রিশ বছরের সাংবাদিক কারমান এই ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্না চালিয়েই পেয়ে গেলেন নোবেল। ইয়েমেনে এখনও কোনও পরিবর্তন আসেনি, পশ্চিম কি ইয়েমেনের শাসককে পাততাড়ি গোটানোর বার্তা দিল? দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক ও লেখক শিশির দাশ লিখেছিলেন, প্রথমে একটি আত্মজীবনী লিখিব কী হইতে পারিতাম তাহা বলিয়া, তাহার পর বাজারে সেটি চলিলে ছদ্মনামে আর একটি আত্মজীবনী লিখিব। তা, নোবেল কমিটি ‘কী করিতে পারিবেন’ বলে যখন বারাক ওবামাকে শান্তি পুরস্কার দিয়েছে ২০০৯ সালে, কারমান কী করিতে পারেন, তার জন্য পুরস্কার পেতে দোষ কী? প্রেসিডেন্ট সালে-র আমলের মন্ত্রীর মেয়ে বোরখায় মাথা-ঢাকা কারমান ইয়েমেনের ইসলামিক পার্টি ইসলা ওয়াসের সদস্য। বজরং দলের বা দুর্গাবাহিনীর সদস্যরাও ভবিষ্যতে নোবেল পাবেন বলে আশা রাখতে পারেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.