সম্পাদকীয় ২...
লক্ষ্মী ও কুবের
ক্ষ্মী বলিতে বঙ্গ-সংস্কৃতিতে কেবল দেবী বিশেষকে বোঝায় না। পুরাণ ও আধ্যাত্মিকতার সহিত মাত্র দেবীর যোগ তাহা নহে। পেচক-বাহনা এই দেবীটি তাঁহার দেবীত্বের সীমা অতিক্রম করিয়া বঙ্গজীবনের অঙ্গ হইয়া উঠিয়াছেন। জীবনযাত্রার বিশেষ এক মানের কথাও এই লক্ষ্মী শব্দটির মধ্যে নিহিত রহিয়াছে। শব্দটি তাই একা থাকে না, অনুসর্গ সঙ্গে গ্রহণ করিয়া থাকে। লক্ষ্মীশ্রী, লক্ষ্মীমন্ত ধরনের শব্দগুলি সুপরিচিত। তাহারা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের শ্রীময়তাকে তুলিয়া ধরে। নিকানো উঠান, কলহহীন সাংসারিক জীবন, গোলাভরা ধান, পরিচ্ছন্ন গ্রাম সমাজ ও পরিবেশ যেন এই শব্দগুলির সহিত লাগিয়া রহিয়াছে। অপচয়বিহীন স্বাস্থ্যময় সুখের যে জীবন সেই জীবনের ছবি চোখের সামনে ভাসিয়া ওঠে। এই সামাজিক শ্রীময়তা তো সকলেরই কাম্য। তাই বঙ্গজ বামপন্থী মানবতাবাদী কবিরা এই দেবীটিকে ও তাঁহার অনুষঙ্গে ভাসিয়া ওঠা চিত্রগুলিকে নাস্তিকতার দোহাই দিয়া বাদ দেন নাই। গ্রহণ করিয়াছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পর্বের কবিতাতে এই শ্রীময়ীর উল্লেখ রহিয়াছে। আছে লক্ষ্মীমন্ত গ্রামজীবনের কথা।
আর রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্রনাথের রচনায় ধনের দুই রূপ উপস্থিত। একটি লক্ষ্মীর ধন, অপরটি কুবেরের। লক্ষ্মীর ধন মানুষকে শোষণ করিয়া সঞ্চিত হয় না। তাহা মানুষের উন্নয়নের কাজে লাগে। আর কুবেরের যে ধন, তাহা শোষণের। অসাম্য আর শ্রীহীনতাই যেন তাহার অঙ্গে লাগিয়া থাকে। প্রাচুর্য রহিয়াছে, কিন্তু সেই প্রাচুর্য শেষ অবধি সাধারণের কল্যাণে লাগে না। রবীন্দ্রনাথ ধনের সাধনার বিরোধী ছিলেন না, ধনের দাপটের বিরোধী ছিলেন। কৃষি ও প্রযুক্তির সমবায় ঘটাইয়া কেমন করিয়া উন্নয়ন সাধন সম্ভব, তাহা লইয়া চিন্তা করিয়াছিলেন। এই চিন্তার ফলিত রূপ তাঁহার শ্রীনিকেতন পর্বের কর্মকাণ্ডে নিহিত ছিল। গ্রামের মানুষকে নানা অর্থনৈতিক উদ্যমের সহিত তিনি যুক্ত করিয়াছিলেন। শ্রীনিকেতন অর্থাৎ শ্রী বা লক্ষ্মীর নিকেতন। ইহা রবীন্দ্রনাথের লক্ষীসাধনা। লক্ষ্মীর সাধনায় তো বাঙালি মনীষীরা অনেকেই অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। বিশেষত বিজ্ঞানসাধকরা। প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও রাজশেখর বসুর নাম স্মর্তব্য। বঙ্গজ চিন্তকরা বুঝিয়াছিলেন, জ্ঞানের সহিত কুবেরের শোষণনীতির ও ধনের অসাম্যের বিরোধ থাকিতে পারে, লক্ষ্মীর সাধনার বিরোধ থাকিবে কেন!
সাধারণ বঙ্গজগণের মধ্যে অবশ্য লক্ষ্মী সম্বন্ধে সচরাচর দুই প্রকার মনোভাব দৃষ্টিগোচর হয়। কিছু মানুষ ধনের সাধনাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। ধনলাভকে তাঁহারা বক্রদৃষ্টিতে দেখেন। ধনের সহিত যেন সর্বদা পাপের সম্পর্ক। তাহা হইবে কেন! আর এক দল আছেন যাঁহারা ধনে উৎসাহী, ধনের সাধনায় নহে। আলস্য ও ফাঁকিবাজি করিয়া তো সদুপায়ে ধন উপার্জন করা যায় না। শ্রম ও উদ্যমই ধনার্জনের উপায়। সেই উপায় অবলম্বন না করিলে ধন লাভ করা সম্ভব নহে। জাতিগত ভাবে যদি বাঙালি অগ্রসর হইতে চাহে তাহা হইলে ধনের সাধনায় অগ্রসর হইতে হইবে। ভারতবর্ষে পুরাকালে দুইটি মার্গ ছিল। একটি প্রবৃত্তির, অপরটি নিবৃত্তির। ধনের সাধনা প্রবৃত্তি মার্গের সাধনা। এই সাধনা রাজসিকতার সাধনা। অনেকে আপন আলস্য ও উদ্যমহীনতাকে ঢাকা দিবার জন্য নিবৃত্তি মার্গকে বড় করিয়া দেখাইতে চাহেন। বিবেকানন্দ তাঁহার কর্মযোগ গ্রন্থে এই অলস নিবৃত্তিবাদীদের তিরস্কার করিয়াছিলেন। ত্যাগের দোহাই দিয়া ফাঁকিবাজিকে যাঁহারা তোষণ করিতে চাহেন তাঁহারা জাতির উন্নতির বাধাস্বরূপ। ইহার বিরোধিতা কর্তব্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.