নোবেল শান্তি পুরস্কার এ বার দেওয়া হইল তিন কন্যাকে। নোবেল কমিটির মতে, পুরুষ-নারীর সমান অধিকার, সমান সুযোগ তৈয়ারি না করিলে বিশ্বে গণতন্ত্র কিংবা শান্তি সম্ভব নহে, তাহা বুঝাইতে তাঁহারা এই তিন জনকে মনোনীত করিয়াছেন। এই বার্তাটি অতি প্রয়োজনীয়, সন্দেহ নাই। নারী-পুরুষ বৈষম্য সমাজে হিংসা এবং অন্যায়ের জন্ম দেয়। যে রাষ্ট্র মহিলাদের অধিকারকে সম্মান করে না, তাহাদের সামাজিক যোগদান এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশের পথ রোধ করিয়া দাঁড়ায়, সেই সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নাই। সেরূপ সমাজে নারীদের দমন করিয়া রাখিতে ক্রমাগত খবরদারি এবং নজরদারি চলিতে থাকে, ফলে শান্তিও সম্ভব নহে। আরব দুনিয়ায় এবং আফ্রিকার একটি বড় অংশে যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চলিতেছে, তখন নারী অধিকারের বার্তাটি সময়োপযোগী, সন্দেহ নাই।
কিন্তু গত কয়েক বৎসর হইতে শান্তি পুরস্কার লইয়া যে বিতর্কগুলি দেখা দিয়াছে, এ বৎসরের পুরস্কার তাহার উপরে উঠিতে পারিল না। বরং অস্বস্তি গভীরতর হইয়াছে। বিজ্ঞান বা অর্থনীতির অন্যান্য বিষয়ে তাঁহারাই পুরস্কার পাইতেছেন যাঁহাদের সাফল্য প্রমাণিত হইয়াছে। কেবল শান্তির ক্ষেত্রে তাহার ব্যতিক্রম দেখা যাইতেছে। কখনও মনে হইতেছে, সাফল্যের প্রত্যাশায় পুরস্কার দেওয়া হইল। কখনও সন্দেহ হইতেছে, পুরস্কৃতের কাজের মূল্য অপেক্ষা তাঁহার পরিচয়ের প্রতীকী মূল্যের ওজন যেন বেশি হইয়াছে। দুইটিতেই যথেষ্ট আপত্তির কারণ রহিয়াছে। কাহারও গাত্রবর্ণ, লিঙ্গ কিংবা ধর্মের জন্য যদি তাঁহাকে বঞ্চনা করা অন্যায় হয়, তবে সেই সকল কারণে তাঁহাকে সবিশেষ স্বীকৃতি দিবারই বা কী কারণ থাকিতে পারে? ইহাও কি এক প্রকার বৈষম্য নহে? নারী-পুরুষ সমানতা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু তাহার জন্য কেবল মহিলাদেরই পুরস্কৃত করিতে হইবে কেন? ইহাতে মনে হইতে পারে যে কেবল মহিলারাই লিঙ্গসাম্যের জন্য আন্দোলন করিতে পারে। ইহা ভ্রান্ত এবং বিপজ্জনক ধারণা। সমাজে সাম্য আনিবার কাজটি পুরুষেরও।
ইয়েমেনের তাওয়াকুল কারমান ৩২ বৎসরের তরুণী, তিনি এই বৎসর জানুয়ারি মাস থেকে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লা সালেহ্-র বিরুদ্ধে আন্দোলন করিতেছেন। তাঁহার দৃষ্টান্ত সে দেশের মহিলা এবং পুরুষ, অনেককেই প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। কিন্তু সেই আন্দোলন এখনও চলিতেছে, এবং তাহার দ্বারা আরব দেশ ইয়েমেনে নারী-পুরুষ বৈষম্য কী ভাবে কতখানি কমিবে, তাহা লইয়া সে দেশেও সংশয় রহিয়াছে। তাঁহার পুরস্কারকে কেহ ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলনের স্বীকৃতি বলিয়া মনে করিতেছেন, কেহ মুসলিম মহিলাদের মধ্যে আধুনিকতার প্রমাণ বলিয়া ভাবিতেছেন। মোট কথা, পুরস্কৃতের দেশ, লিঙ্গ, ধর্ম যেন বড় হইয়া উঠিয়াছে, পুরস্কৃত কী করিয়াছেন, কতখানি সাফল্য পাইয়াছেন, তাঁহার কাজ বিশ্বে অন্যান্যদের কতখানি অনুপ্রাণিত করিয়াছে, তাহা যেন গৌণ হইয়া যাইতেছে। লাইবেরিয়ার সমাজ আন্দোলনকারী লেমা জিবোউই অবশ্য গৃহযুদ্ধের হিংসাকীর্ণ দিনগুলিতে মহিলাদের হিংসার বিরুদ্ধে সংগঠিত করিবার কাজটি করিয়াছিলেন। কিন্তু সে দেশের প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন-সারলিফ আফ্রিকার ‘প্রথম নির্বাচিত মহিলা প্রেসিডেন্ট’ তকমা বহন করিতেছেন, যাহা ‘প্রথম মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট’-এর নোবেল জিতিবার মতোই বিতর্ক সৃষ্টি করিবার সম্ভাবনা রাখে। শেষ বিচারে বলিতে হয়, যে কোনও পুরস্কারই কিছু না কিছু বার্তা পাঠায়, কিন্তু বার্তা পাঠানোই পুরস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য নহে। সমাজে উৎকৃষ্ট অবদানের স্বীকৃতিই তাহার প্রধান উদ্দেশ্য। তাহা ভুলিলে পুরস্কৃতকেও অসম্মান করা হয়। |