দু’দশক আগে রাম রথযাত্রার হাত ধরে শুধু লালকৃষ্ণ আডবাণীর নয়, উত্থান হয়েছিল বিজেপিরও। কিন্তু আগামিকাল ষষ্ঠ বার রথে চড়ার ঠিক এক দিন আগে আডবাণীর মনে এল চোদ্দ বছর আগের এক রথযাত্রার কথা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে ১৯৯৭ সালের স্বর্ণজয়ন্তী রথযাত্রা।
কারণ?
খোদ আডবাণীর কথাতেই, “সেই যাত্রার পরের বছরেই ক্ষমতায় এল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। টানা ছ’বছর সেই সরকার সুশাসন দিল।”
তাঁর এ বারের রথযাত্রার এক দিন আগে দিল্লিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে গত পাঁচটি রথযাত্রার মধ্যে ‘বিশেষ’ একটিকে বেছে নিয়ে আডবাণী বুঝিয়ে দিলেন, কাল থেকে শুরু হওয়া যাত্রার মূল উদ্দেশ্যই হল কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরে আসার লড়াই। এই প্রসঙ্গে আগামিকাল জয়প্রকাশ নারায়ণের জন্মদিনে তাঁরই জন্মস্থল থেকে যাত্রা শুরুর যৌক্তিকতা কী, তা-ও ব্যাখ্যা করলেন তিনি। সেখানেও একই সুর বেঁধে দিয়ে বললেন, “আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে জয়প্রকাশ নারায়ণই প্রথম দিল্লিতে কংগ্রেস সরকার বদল করেছিলেন।”
শুধু সরকার বদলই নয়, এই যাত্রার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে টিকে থাকার প্রশ্নে তাঁর লড়াইও যে শেষ হয়নি, তা-ও এ দিন স্পষ্ট করে দিলেন আডবাণী। সঙ্ঘ পরিবার যতই তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে বাদ রাখতে সক্রিয় হোক, রথযাত্রার এক দিন আগে আডবাণী সেই সম্ভাবনা তো খারিজ করলেনই না, বরং তাকে আরও জিইয়ে রাখলেন। |
যাত্রা শুরুর আগে দিল্লিতে।-নিজস্ব চিত্র |
লোকসভা নির্বাচনের এখনও ঢের দেরি। কিন্তু কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নিয়ে রথে ওঠার এক দিন আগে আজ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করলেন তিনি। বললেন, “২০০৮ সালে অর্থ দিয়ে ভোট কেনার সময়ই নেতৃত্ব দেওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে এই সরকার।” তাঁর কথায়, ওই ঘটনার পর থেকে একের পর এক দুর্নীতিতে জড়িয়েছে সরকার, মূল্যবৃদ্ধির আঁচে নাজেহাল আম-আদমি। কালো টাকা উদ্ধার নিয়েও সরকার তৎপর নয়। এ সব নিয়ে সরকারকে তুলোধনা করতে গিয়ে আডবাণী তুললেন লোকপাল, বিচার ব্যবস্থার উচ্চপদে দুর্নীতি প্রসঙ্গও। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রচার করতে রথে কেন? আডবাণীর কথায়, “অনেক সময় বড় বড় জনসভায় অনেক মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আসেন না। কিন্তু যাত্রার মাধ্যমে এমন বহু প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ জনের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, যাঁরা টেলিভিশন দেখেন না।” যোগগুরু রামদেব বা অণ্ণা হজারের মতো অরাজনৈতিক নেতাদের আন্দোলন থেকেই যে তাঁর এ বারের রথযাত্রা অনুপ্রেরণা পেয়েছে, তা-ও কবুল করলেন।
আডবাণী রথে চড়ার আগের দিন যা-ই বলুন, এ বারের যাত্রা যে তাঁর কাছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, তা স্বীকার করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা। যখন থেকে আরএসএস নেতৃত্ব তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড় থেকে বাদ রাখার কথা বলেছেন, তখন থেকে দলের অনেক নেতা তাঁর থেকে দূরে সরেছেন। এমনকী একদা ঘনিষ্ঠ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব বেড়েছে। যদিও আজই মোদী জানান, তাঁর সঙ্গে আডবাণীর সম্পর্ক নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তা ‘চূড়ান্ত দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়’। এমনকী এই রথযাত্রার প্রশংসাও করেন তিনি। আডবাণীও আজ বলেন, “কিছু দিন আগেই মোদীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। গুজরাতে রথ ঢোকার সময় তিনি থাকবেন বলে জানিয়েছেন।” ঘরের কোন্দলের পাশাপাশি বিরোধীরাও এই রথযাত্রা বিফল করতে সক্রিয়। যাত্রা শুরুর আগেই কংগ্রেস, লালুপ্রসাদ যাদব তো বটেই, বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও বিরোধিতায় সরব। তা ছাড়া, রাম রথযাত্রার পর বাকি চারটি যাত্রা সে ভাবে সাড়াও ফেলেনি। দলের অনেকে এ বারের যাত্রার সাফল্য নিয়েও সন্দিহান।
১৯৯০ সালে রাম রথযাত্রার পরেই উত্থান হয় বিজেপির। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেই বিজেপি ১২০টি আসনে পৌঁছে গিয়েছিল। বাজপেয়ী জমানায় সেটি বেড়ে ১৮০-র কোঠাও পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ভোট ধরে রাখতে পারেনি তারা। গত লোকসভা নির্বাচনে আডবাণীকে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী করে লড়ে ১২০-র কোঠাতেই আটকে গিয়েছে দল। বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, দলের কাউকে তখনই প্রধানমন্ত্রী করা সম্ভব, যখন দল পুরনো গৌরব ফিরে পাবে। নিজের শক্তিতে ক্ষমতা দখলের অবস্থায় আসতে পারবে। সেটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে আডবাণীকে।
এর পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে নেমে বিজেপির নিজের ঘরের সমস্যাও কম ভোগাচ্ছে না। দুর্নীতির অভিযোগে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাকে ইস্তফা দিতে হয়েছে। আডবাণীর যাত্রার সময়েই পাল্টা যাত্রা শুরু করতে চাইছেন ইয়েদুরাপ্পা। দুর্নীতির আঁচ পেয়ে আগেভাগেই উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দিতে হয়েছে রমেশচন্দ্র পোখরিয়ালকে। সঞ্জয় নিরুপমের মতো কংগ্রেস নেতারা পটনায় গিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন, “বিজেপি ও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির দুর্নীতি দেখতে পারেন না আডবাণী। তাই আমরা যাত্রার সময় কালো পতাকা দিয়ে এর বিরোধিতা করব।” দলের দুর্নীতি প্রসঙ্গে আডবাণীর সাফাই, “আমাদের দলে দুর্নীতির ঘটনা শক্ত হাতেই মোকাবিলা করা হচ্ছে। কোনও ভাবেই কাউকে রেয়াত করা হচ্ছে না।”
বয়স আশির কোঠা পেরিয়েছে। দলের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে কটাক্ষ করে ‘ভীষ্ম পিতামহ’ বলেন। টানা প্রায় চল্লিশ দিন ধরে রথযাত্রা করে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে প্রমাণ করতে হবে, ভোট যুদ্ধে বিজেপির ‘অর্জুন’ হতে পারেন তিনিই।
লড়াইটা সত্যিই কঠিন। |