অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার
কটু বেশি রাত্তিরের দিকে আমাদের জানলার বাইরেটা বেশ লাগে। আমি তো নিয়ম করে গ্রিল-এ নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি তখন। কিছু পর থেকেই টের পাই একটা আবেশ শুরু হচ্ছে, খুব মিহি ভাবে। ব্যস, আরও আটকে যাই। বাইরে কী দেখি? প্রায় মরে মরে বেঁচে থাকা কিছু সবুজের প্যাচ, এক-আধটা শেষ-রাতের কাক, অতি-আগ্রহী কুকুরের গ্যাং, দূরের নীল লাল নাইট ল্যাম্প আর যেটুকু সম্ভব, অন্ধকার।
এই অন্ধকারটাই তো আমি দেখতে চাই। দেখবেন রাস্তার বাতির ক্ষমতা যেখানে শেষ হয়, ঠিক সেই রেখা থেকেই পা মেলতে থাকে অন্ধকার। একটু চর্চা করলে বোঝা যায় এরা খুব ইন্টারেস্টিং। আমার থেকে সব সময় এক পা দূরে দাঁড়িয়ে। কখনও ঘাড়ে উঠে বসবে না, আবার পিছুও ছাড়বে না। আমার ধারণা, ওরাও জুলজুল করে দেখে আমায়। চুপ করে জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিঁঝিঁ শুনছি একটা দুর্ভাগা পাবলিক।
পুজোর এ ক’দিন অবশ্য অন্ধকার, শিঁটিয়েই থাকে বেচারা। তখন তো প্রতিটি (অ)কল্পনীয় কোণ থেকে আলো ঝামরে এসে পড়ে, অন্ধকার ভারী অসহায়। লুকোবে যে, লুকোবে কোথায়? এক্কেবারে আমাদের মতো, রোজদিনের হ্যানও ত্যানও ঘ্যানরঘ্যানও। এই রেটে কদ্দিন ঘষটাব, কে জানে? ইতিহাস ও বাঙালি বলছে, এই পর্যন্ত এসে আমরা খেলা ছেড়ে দিতে অভ্যস্ত।
তবু, আর এক দান চেষ্টা হোক না। কী করে? ওই যে অন্ধকার, ওই টানা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে হবে ওর সঙ্গে। একটা সম্পর্ক হবে ধীরে, নিজের সময়ে। প্রথম প্রথম হয় একঘেয়ে লাগবে নয় মেলোড্রামাটিক। চোখ সয়ে গেলে বুনোট অন্ধকারেও দেখতে পাবেন কিছু ফিগার। দেখে যদি মনে হয় ওটা মালাইকা বা মাস শেষে আপনার বস-এর মাইনে, তা হলে আপনি এখনও প্রস্তুত নন। অধ্যবসায় চাই আরও। মুশকিল হচ্ছে, আমরা আলোর তলায় যা কিছু দেখছি বা দেখতে চাইছি, হুবহু তাই-ই অন্ধকারেও খুঁজে চলি। আগে থেকে মাথায় গেঁথে দেওয়া একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আর এক বার স্থাপন করতে চাই ওই অন্ধকারে। কিন্তু এখানে তো অন্য নিয়ম, অন্য প্যাটার্ন। অন্ধকারকে তো দেখতে হবে, তার শর্ত মেনে।
অন্ধকার মানে আসলে শূন্যতাও। একটা ‘অনেকটা’ ফাঁকা। সেই ফাঁকায় কোনও দিন তৈরি হবে একটা নির্দিষ্ট কিছু। তাই, অন্ধকার মানে শ্বাসচাপা অপেক্ষাও। আর সেই অপেক্ষার পরই আসবে একটা সৃষ্টি। অন্ধকারে তৈরি হবে কিছু অবয়ব। একেবারে নিজের মতো করে। যেখানে কোনও রকম আলোর পা রাখা নিষিদ্ধ। সেই অবয়ব তো অন্ধকার লেপে লেপেই দাঁড় করানো হয়েছে। মানে অন্ধকার সয়ে যাওয়া চোখ কিছু একটা সৃষ্টি করল, পুরোপুরি অন্ধকারের ধর্ম মেনেই। তার অস্তিত্ব অন্ধকারেই, আলো ফেললে খানখান হবে তা নিমেষে।
কিন্তু আমরা সৃষ্টি বা অন্ধকার, কোনওটাতেই অভ্যস্ত নই। অতএব সমস্যা। স্টেজের শেষ আলো নিভতে না নিভতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যাই। অন্ধকার সামনে থাকলে বিরক্ত হয়ে বলত, এত ক্ষণ যা দেখলে, সেটা বসে একটু আত্মস্থ করা যাক, রসটা থিতিয়ে যাক, যাক না বাকিরা উঠে, তোমার তাতে কী? হুড়োহুড়ি করে হল থেকে বেরোলে খুব বেশি হলে আগে ট্যাক্সি পাবে, আর কিছু? কিচ্ছু না। আসলে আমরা তো শুধু ফাইনাল প্রোডাক্ট নিয়েই ব্যস্ত, আগে-পরের ঘ্যানঘ্যান হাইলাইট্স-এ দেখে নেব বা ফুটনোট-এ ছাপিয়ে দেব। এখানেই অন্ধকার শেখাবে অন্য পাঠ। বলবে, জানতে হলে শুরুর অন্ধকার থেকে শেষের অন্ধকার অবধি থাকো, উপভোগ করো। লম্বা সফরটা অনুভব করো। শুধু আলোর তলায় দারুণ থিম-প্যান্ডেল দেখে কেয়া বাত বহুত আচ্ছা, এ সব করলে ছবিটা খাপছাড়া হয়। উচিত হচ্ছে, ফাঁকা মাঠে যে দিন থেকে বাঁশ পড়েছিল, সে দিন থেকেই সময় ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়া। দাঁড়িয়ে দেখা, কী ভাবে একটার পর একটা বাঁশ আর দড়ি গিঁট বেঁধে বেঁধে কারও কল্পনাকে বাস্তব করছে। আমরা ভাবি, আমি তো কিছুই করছি না, বোকার মতো দাঁড়িয়ে কী হবে? ভুল। এ ভাবেও সৃষ্টির শরিক হওয়া যায় কিন্তু। সৃষ্টিকর্তার মরাল সাপোর্ট পাওয়া যাবে, সে নয় ছেড়েই দিলাম, নিজের মধ্যেও না এক সময় সৃষ্টির ছন্দ ঢুকে যাবে। আর তখনই মনটা আনচান করতে লাগবে, ভিতরের ঘুমিয়ে থাকা বাসনা, ক্ষমতা, স্পর্ধা সব আবার পেটের মধ্যে গুলোতে শুরু করবে, হঠাৎ করে একটা দান খেলতে খুব খুব ইচ্ছে করবে... পাকামি না, এ-রকমটা হয় কিন্তু, বিশ্বাস করুন!
সেই নতুন তরঙ্গ আরও জল পাবে আলো ঝলমলে শরতের আকাশে। চারিদিক আলোকময় থাকলে তো এমনিই মন ফুরফুরে লাগে। তার রেশ কাটতে শুরু করে ভাসানের পর। যে প্যান্ডেল ঘিরে এ ক’দিনের উন্মাদনা, সেও ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে। বাঁশের গা থেকে কাপড় সরে, দড়িগুলোও এত টানাপড়েনের পর ঘুম-ক্লান্ত, আলোর চেন-ও কার্নিশ থেকে নেমে মাটিতে গুটিয়ে, লুটিয়ে, সৃষ্টিকর্তার কল্পনা আবার শুকনো শুকনো কাঠ কাঠ। আমরাও তো আর ও-মুখো হই না। কারণ ওখানে তো এখন শুধুই অন্ধকার, কেউ যায়?
ভুল করি। কোনও কাজ ভাল ভাবে শুরু করা যেমন একটা আর্ট, ভাল শেষ করাও তাই। পারলে প্যান্ডেল খোলার সময়ও সেই মাঠে নীরব উপস্থিতি দেওয়া দরকার। তখন ঠিকঠাক নিয়ম মেনে একটা বাস্তব আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, অন্য কোনওখানে ফুটে উঠবে বলে। কোনও চিৎকার নেই, হল্লা নেই, বুক চাপড়ে কান্না, তাও না। এক রকম রূঢ় শৃঙ্খলা মেনে জাস্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে।
শেষ আসলে ওই ভাবেই হয়, খুব অনাড়ম্বর ভাবে। আমরাই কিছু কিছু না-পাওয়াকে বিরাট মূল্য দিয়ে চেঁচিয়ে-ফেঁচিয়ে একাকার করি। অথচ বুঝি না প্রত্যেক অন্ধকারই আর একটা শুরুর ব্লুপ্রিন্ট তৈরির সুযোগ!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.