|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
হোমসিয়ানায় নতুন করে প্রাণিত করে |
আশিস পাঠক |
শার্লক হোমস সমগ্র, প্রথম খণ্ড, সটীক সংস্করণ, অনুবাদ অদ্রীশ বর্ধন,
টীকা ও সম্পাদনা প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, সৌম্যেন পাল। লালমাটি, ৪০০.০০ |
তোপসে লিখেছিল ফেলু মিত্তিরের গোয়েন্দাগিরির কাহিনি। আর যদি তাদের টীকা করতেন সিধু জ্যাঠা? করলে ফেলু মিত্তিরের ভাত মারা যেত কি না জানা নেই, তবে বাংলা বইয়ের মল্লিনাথদের যে যথেষ্ট বিপদে পড়তে হত সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। বস্তুত এ কথা অনেক দিন ভেবেছি যে, বইয়ের টীকাকার-সম্পাদক আর গোয়েন্দার কাজটা তো অনেকটা একই রকম। গোয়েন্দাকে রাখতে হয় বিচিত্রবিদ্যার খোঁজখবর, বইয়ের সম্পাদককেও। সূক্ষ্ম বুদ্ধির দরকার গোয়েন্দার, সম্পাদকেরও। এত মিল যেখানে, সেখানে গোয়েন্দাকাহিনির কেন সটীক সংস্করণ হবে না? ইংরেজিতে এ ধরনের সংস্করণ থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু বাংলায় এমন সংস্করণ স্বয়ং ব্যোমকেশ বক্সীও খুঁজে এনে দিতে পারবেন না। অথচ সত্যান্বেষী তো বটেই, কিরীটি এমনকী ফেলুদা পর্যন্ত যে সময়ে গোয়েন্দাগিরি করেছেন সেই সময়টাকে আরও ভাল করে বোঝার জন্য এবং কাহিনির মজাটা আরও ভাল করে পাওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই টীকার দরকার হয়। আর ‘সটীক’ বললেই যে একটা গুরুগম্ভীর গবেষণামূলক নীরস নন-ফিকশন ডমরু আমাদের মনে বেজে ওঠে সে ধারণাটা এ বার ভাঙা দরকার।
বাংলায় সটীক গোয়েন্দা-কাহিনির সেই বহু কালের স্বপ্নটি সার্থক করলেন বাংলা সম্পাদনার দুই তরুণ মল্লিনাথ, সৌম্যেন পাল এবং প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত। তবে এই প্রথম উদ্যোগটি খাঁটি বাংলা গোয়েন্দাকাহিনিতে হল না, হল ইংরেজি গোয়েন্দাকাহিনির বাংলা অনুবাদে। তার জন্য একটা আক্ষেপ রইল। অবশ্য, অনূদিত বলেই মল্লিনাথদের কাছে চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি শক্ত। কারণ স্যর আর্থার কন্যান ডয়্যালের শার্লক হোমসের বহু গল্পে এমন সব প্রসঙ্গ আছে যা বিদেশি দুই টীকাকারের পক্ষে সহজে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। সে কাজে এই দুই তরুণ কতটা সফল সেই বিচারটাই আজকের বিচার। অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদ নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকলেও সে অনুবাদ পুরনো, তার সুখপাঠ্যতা ইতোমধ্যেই তর্কাতীত।
বাংলায় শার্লক হোমসের কাহিনি অনুবাদের ধারায় অদ্রীশ বর্ধন ইতিহাস হয়ে আছেন। বস্তুত বাংলায় এখনও পর্যন্ত হোমসের সামগ্রিক এবং সেরা অনুবাদের কৃতিত্ব তাঁরই। ১৯৭৭-এ বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে তাঁর যে পাঁচ খণ্ডের হোমস-অনুবাদ প্রকাশিত হয় তা-ই বাঙালি গোয়েন্দাদের পাশাপাশি হোমসকেও আম বাঙালির কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। তার আগেও হোমস-কাহিনির অনুবাদ হয়েছে। ১৯৩২-৩৩-এ ‘বাস্কারভিলের কুকুর’ ও ‘শার্লক হোমসের বিচিত্র কীর্তি’ নামে হোমস-কাহিনির অনুবাদ করেছিলেন কুলদারঞ্জন রায়। তার পরে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ‘জলার পেতনি’ নামে ‘দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস’-এর অনুবাদ করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ও অনুবাদ করেছিলেন দু-একটি উপন্যাসের। কিন্তু এ সব ছিল বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। অদ্রীশ বর্ধনই প্রথম ধারাবাহিক ভাবে হোমসের উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থগুলি থেকে প্রায় সবকটি কাহিনির অনুবাদ করেন। সেই অনুবাদগুলি এত বছর পরে ফের খণ্ডে খণ্ডে সুলভ হচ্ছে, এ ঘটনা বাংলা সাহিত্যের এই গোয়েন্দা-খরায় নতুন আশা জাগায়, হোমসিয়ানায় নতুন করে প্রাণিত করে।
এই সটীক সংস্করণের প্রথম খণ্ডটিতে আছে চারটি উপন্যাস ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’, ‘দ্য সাইন অব দ্য ফোর’, ‘দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস’ এবং ‘ভ্যালি অব ফিয়ার’। হোমস-উপন্যাস এই চারটিই। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৭ থেকে ১৯১৫-র মধ্যে। রচনাকালও প্রকাশকালের কাছাকাছি। সুতরাং ঊনবিংশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকের ইংলন্ডের ইতিহাসে রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি করতে হয়েছে দুই টীকাকারকে।
সম্ভাব্য প্রায় সব প্রসঙ্গের টীকা করেছেন দুই টীকাকার। তার সূক্ষ্মতা রীতিমতো বিস্ময় জাগায়। যেমন, ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’-এর শুরুতেই যেখানে আছে ‘ভূতপূর্ব মিলিটারি ডাক্তার জন এইচ ওয়াটসন এম ডি-র স্মৃতিচারণ থেকে পুনর্মুদ্রিত’, সেখানে ‘এইচ’ শব্দটি সটীক। টীকাকারেরা জানাচ্ছেন, ওয়াটসনের নামে ‘এইচ’ স্কারলেট ছাড়া আর দেখা গিয়েছে ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য প্রায়োরি স্কুল’ এবং ‘দ্য প্রবলেম অব থর ব্রিজ’-এর গল্পে, কিন্তু ‘এইচ’-এর পুরো কথাটি কোথাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। কিংবা ‘জিজেল’ বুলেটের প্রসঙ্গটিই ধরা যাক, যা এত কাল ‘ডিজেল’ বুলেট হয়ে ছিল অনুবাদে। এই সটীক সংস্করণে সেই হাস্যকর ভুল শোধরানো হয়েছে, জিজেল যে আফগানদের ব্যবহৃত এক রকমের বিশেষ বন্দুক সে তথ্য জানানো হয়েছে টীকায়।
তবে এই সটীক সংস্করণটি পড়তে পড়তে যে কথা বার বার মনে হয়েছে তা হল অনেক ক্ষেত্রেই টীকায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন ওয়াটসন ১৮৭৮ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক্তারির ডিগ্রি নিয়েছিলেন এই বাক্যটির সূত্রে লন্ডন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস না দিলেও চলত। অধিকন্তু ন দোষায়, এই আপ্তবাক্যটি কিন্তু সম্পাদনায় প্রযোজ্য নয়, কারণ সে ক্ষেত্রে অকারণ বইয়ের মেদবৃদ্ধি হয়। আর যে অভাবটি বার বার অনুভব করেছি তা হল মানচিত্র। হোমসের সমকালীন ইংল্যান্ডের বিশেষ কিছু অঞ্চলের মানচিত্র প্রায় অপরিহার্য ছিল এই সংকলনে। কারণ, টোপোগ্রাফিটি মনের মধ্যে স্পষ্ট করে নিতে না পারলে গোয়েন্দাকাহিনি প্রায়শ তার সম্পূর্ণ অভিভবে ধরা দেয় না। মনে পড়ছে, শরদিন্দুর ‘চিড়িয়াখানা’য় গোলাপ কলোনি-র মানচিত্র। হোমস-কাহিনিতে মানচিত্র আরও জরুরি ছিল পাঠকের জন্য, কারণ ঘটনার ভূগোল সেখানে অপরিচিত তো বটেই, কল্পনা করাও বেশ কষ্টসাধ্য।
অবশ্য সমসাময়িক মেজাজটা বেশ কিছুটা ধরে রেখেছে এই সংস্করণের অলংকরণগুলি। নতুন কোনও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়নি এখানে, সম্পাদকেরা খুঁজেপেতে নিয়ে এসেছেন হোমস-কাহিনির প্রথম প্রকাশের সময়কার আদি অলংকরণগুলি। যেমন, ‘বিটনস ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’-এর সেই সংখ্যার প্রচ্ছদ ফ্যাকসিমিলি ছাপা হয়েছে যেখানে প্রথম হোমস-কাহিনি ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ প্রথম প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া আছে একই উপন্যাসের ‘ওয়ার্ড, লক, বাওডেন অ্যান্ড কোং’ প্রকাশিত ১৮৯৩-এর সংস্করণ থেকে হাচিনসনের সেই বিখ্যাত অলংকরণটি যেখানে ওয়াটসন-হোমসের প্রথম সাক্ষাৎ। ‘দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন’, ‘দ্য লিপিনকট ম্যাগাজিন’, প্রথম দিককার গ্রন্থ-সংস্করণ এবং বিভিন্ন অনূদিত সংস্করণ থেকে ডি এইচ ফ্রিস্টন, গুডস্মিড, জ্যাক উইলস, সিডনি পাগেট প্রমুখের করা অলংকরণগুলিও উৎস-বিবরণ সমেত আলো করে আছে এই সটীক সংস্করণ। আছে হোমস-কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলির প্রচারচিত্রও। প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে ফ্রাঙ্ক উইলসের আঁকা হোমস-প্রতিকৃতি।
মনে রাখার মতো এই সংস্করণে দু’একটি বিষয়ে টীকাকারেরা অমনোযোগী। প্রথমত, আর্থার কন্যান ডয়্যালের উপন্যাসটির প্রকৃত নাম প্রথম পত্রিকা-প্রকাশের সময় ছিল ‘দ্য সাইন অব দ্য ফোর, অর, দ্য প্রবলেম অব দ্য শোল্টোজ’, পরে স্পেনসার ব্ল্যাকেট থেকে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ-সংস্করণে নামটি হয় ‘দ্য সাইন অব ফোর’। এই সংস্করণে উপন্যাসটি ছাপা হয়েছে ‘দ্য সাইন অব ফোর’ নামেই। ইংরেজিতেও অনেক সংস্করণে একই নামে উপন্যাসটি ছাপা হয়েছে। লিপিনকট’স মান্থলি ম্যাগাজিনে প্রথম যখন ধারাবাহিক ভাবে উপন্যাসটি ছাপা হতে থাকে তখন নামে দ্বিতীয় ‘দ্য’-টি ছিল, গ্রন্থ-সংস্করণে উধাও হয়। পরে ব্রিটিশ ও আমেরিকান অধিকাংশ সংস্করণেও এই নামটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু উপন্যাসের পাঠে সর্বত্র সংকেত-প্রসঙ্গে ‘দ্য সাইন অব দ্য ফোর’ই লেখা হয়েছে। টীকায় এই প্রসঙ্গটির আলোচনার দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, ‘দ্য ভ্যালি অব ফিয়ার’ সূচিতে এবং রানিং টাইটলে ‘ভ্যালি অব ফিয়ার’ হয়ে গিয়েছে। তৃতীয়ত, ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’-কে বলা হয়েছে ‘শার্লক হোমসের প্রথম কেস’। তা নয়। এটি আসলে প্রথম প্রকাশিত হোমস-কাহিনি। হোমসের প্রথম কেস অন্য, সে গল্পের নাম ‘দ্য “গ্লোরিয়া স্কট’”, প্রথম সংকলিত হয় মেমোয়ার্স অব শার্লক হোমস বইয়ে। চতুর্থত, এই সটীক সংস্করণের প্রচ্ছদে হোমস-স্রষ্টার নামে ‘কন্যান ডয়্যাল’, আখ্যাপত্রে ‘কন্যান ডয়াল’, আবার টীকায় ‘কোনান ডয়েল’। ভুলগুলি হয়তো সূক্ষ্ম, কিন্তু দুই টীকাকার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লেসট্রেড-গ্রেগসন হবেন, না ২২১বি বেকার স্ট্রিটের হোমস তা কিছুটা হলেও নির্ভর করে এই সূক্ষ্মতার উপর।
অবশ্য এ হেন সম্পাদকীয় গোয়েন্দাগিরিতে মল্লিনাথদের হাতেখড়ি হল সবে। পরের কেসে তাঁরা আরও সূক্ষ্ম নজরের পরিচয় দেবেন, আমি নিশ্চিত। |
|
|
|
|
|