|
|
|
|
লক্ষ্মীমন্ত |
লক্ষ্মী মেয়ের দাপট |
দময়ন্তী সেন। যুগ্ম কমিশনার, অপরাধ দমন, কলকাতা পুলিশ।
স্ত্রী,
মা আবার অপরাধীর যম। এবং ভীষণ অন্তর্মুখী। লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
না, সিনেমা সব সময় সমাজের আয়না নয়!
বলিউডের সিনেমায় মহিলা পুলিশ বললেই তো ভুস করে ওঠে হেমা মালিনী, বিজয়াশান্তি, শিল্পা শেট্টিদের মুখ। লম্বা-চওড়া চেহারা। মেজাজি, মারকুটে। খাকি উর্দি পরে লম্বা-লম্বা পায়ে বদমাইশদের বাইসাইকেল কিক মারছেন।
আমার চোখের সামনে বছর ৪২-এর যে শান্ত মহিলাটি বসে তিনি সেই ইমেজের সঙ্গে কী ভীষণ বেমানান!
তা সত্ত্বেও স্রেফ তাঁর নামেই কলকাতার অপরাধজগত সচকিত! সকাল-সন্ধে তাঁকে সেলাম ঠোকে লালবাজার!
তিনি দময়ন্তী সেন।
“দাপট মানে কি মারকুটে হওয়া? লোকের ধারণা পুলিশ মানেই ‘শত্রু’র জিৎ-মার্কা মারপিট করবে (লেটেস্ট বাংলা ছবির খবরও রাখেন!)? আমার মতে, উচ্চপদস্থ আইপিএসের সবচেয়ে বেশি দরকার ম্যানেজেরিয়াল স্কিল। কোম্পানি চালানো আর ফোর্স চালানো একই। ম্যান ম্যানেজমেন্ট হল মূল কথা। এক জন আইপিএসকে সবচেয়ে আগে ভাল সি ই ও হতে হবে।” কেটে কেটে বলেন দময়ন্তী।
কিন্তু পুলিশ যে এখনও ভীষণ পুরুষপ্রধান পেশা! কিরণ বেদির মতো ডাকাবুকো মহিলা না হয় সামলাতে পেরেছেন। তাই বলে দময়ন্তীর মতো চুপচাপ, শান্ত, রোগাপাতলা মেয়ে?
ঠিক কতটা পথ কী ভাবে পেরিয়ে অপরাধ দমন শাখার প্রধান হলেন?
দুঁদে গোয়েন্দা তত ক্ষণে স্টোরির ক্যাচলাইন আঁচ করতে পেরে দ্বিগুণ সাবধানী। “এতে আবার মহিলা-পুরুষের কী আছে? রাজ্যে প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দেখছি আমাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের উৎসাহ বেড়ে গিয়েছে। ওই সব নিয়ে কোনও মন্তব্য পাবেন না।”
কিন্তু এই সংযোগ টানার চেষ্টা তো হবেই। রাজ্য সামলাচ্ছেন এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রী আর সেই রাজ্যের রাজধানীর অপরাধ দমনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আছেন এক মহিলা আইপিএস। চমকপ্রদ, নয়?
আলাদা করে এই ‘মহিলা’ ব্যাপারটায় জোর দেওয়ায় ঘোরতর আপত্তি দময়ন্তীর। বলেন, “মহিলা পুলিশ নিয়ে লোকে বেশি কৌতূহল দেখায় যেহেতু এই পেশায় এখনও তুলনায় মেয়ে কম। কয়েক বছর পর যখন মেয়ে ও ছেলে সমান-সমান হয়ে যাবে তখন আর আলাদা করে পুলিশের মেয়ে হওয়ার মধ্যে আগ্রহ থাকবে না।” তাঁর কথায়, তখন নাকি আরও ভাল হবে। কারণ ছেলেদের তুলনায় এমনিতেই মেয়েরা যে কোনও কাজে বেশি সৎ আর সিরিয়াস।
তা-ও কী ভাবে মুখচোরা, বইয়ে মুখ গোঁজা একটা মেয়ে একরোখা পুলিশ-উওম্যান হয়ে উঠলেন সেই গল্পটা জানব না? সাক্ষাৎকার এড়াতে চাওয়া দময়ন্তী এ বার চার লাইন বলেই ইন্টারভিউ শেষ করতে চান। আবার অনেক বলেকয়ে দু-লাইন বলানো যায়, আবার থামেন। জোরাজুরি করলে একটাই জবাব, “বলেই তো ছিলাম। আমার জীবনে ইন্টারেস্টিং কিছু নেই।” এই ভাবেই কথা এগোতে থাকে সিঁড়ি ভেঙে-ভেঙে। থেমে থেমে।
আর টুকরো কোলাজে ধরা পড়েন অধরা দময়ন্তী।
***
বাড়িতে প্রিয়জনদের মধ্যে অনেকেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বৈজ্ঞানিক ছিলেন। পড়াশোনায় ভাল মেয়ে তাঁদের সামনে রেখেই কিছু একটা হওয়ার স্বপ্ন দেখত। পুলিশ হওয়ার কথা কোনওদিনই ভাবেননি। সেটা আচমকাই হয়েছে। শুধু ভেবেছিলেন ভাল একটা চাকরি করতে হবে আর সেটা ইউপিএসসি-র হলে চমৎকার হয়। অর্থনীতি নিয়ে যাদবপুর থেকে স্নাতক আর স্নাতকোত্তরে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তার পরই ইউপিএসসি-তে বসলেন। টার্গেট ছিল আইএএস। পেলেন আইপিএস। সেটা ১৯৯৬ সাল। চ্যালেঞ্জটা নিয়ে নিলেন। বাড়ি থেকেও খুব একটা আপত্তি এল না। মোড় ঘুরে গেল জীবনের।
আইপিএসের ট্রেনিং শুরু হল। ঘোড়ায় চড়া, খালি হাতে লড়াই, ক্যারাটে, দৌড়, বন্দুক চালানো, সব কিছু। সেই সঙ্গে মনটাকে প্রস্তুত করতে হয়েছিল এই পেশার জন্য। থেরাপির কাজ করেছিল তখনকার একটা হিন্দি সিরিয়াল। কবিতা চৌধুরির ‘উড়ান’। ’৯০-দশকের একেবারে গোড়ায় কবিতার নিজের দিদি কাঞ্চন চৌধুরির (যিনি প্রথম মহিলা ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ হয়েছিলেন অনেক লড়াই করে) জীবন অবলম্বনে তৈরি ওই সিরিয়াল প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। দূরদর্শনে দেখানো হত। দময়ন্তী তখন ছাত্রী। ট্রেনিংয়ের সময় বা পরবর্তীকালে চাকরি জীবনে চড়াই-উতরাইয়ে ঠোক্কর খেলেই মনে করে নিতেন ‘উড়ান’-এর কথা। লড়াইয়ে ফেরার শক্তি পেতেন। আর মনে মনে জপ করতেন, “এক বার ঢুকে পড়েছি, আর পিছু হঠা নয়। প্রত্যেক চাকরির মতো এরও কিছু শর্ত আছে, কিছু দাবি আছে। সেগুলো মেনে নিয়ে সবার থেকে ভাল করে এটা করতে হবে।”
প্রথম পোস্টিং দক্ষিণ ২৪ পরগনার অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার (টাউন)। সেখান থেকে ওই জেলারই অ্যাডিশন্যাল এস পি। তার পর ক্রমে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার (স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ), ডিসি নর্থ, ডিসি সেন্ট্রাল, অবশেষে জয়েন্ট কমিশনার, ক্রাইম। এনকাউন্টারে প্রথম যে দিন কাউকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে হয়েছিল সে দিন কি রাতে দেরি করে ঘুম এসেছিল? স্থির দৃষ্টিতে জবাব আসে, “না। আমার কাজের জন্য ওটা করতে হবে এটাই আমার কাছে যথেষ্ট ছিল। এটা পুলিশের পেশার অঙ্গ। আমি মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।”
একটা প্রশ্ন তবু থেকে যায়। এই শহরেই পুলিশের অভিযান চলাকালীন প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে, কুপিয়ে, পুড়িয়ে খুন করা হয়েছিল আইপিএস বিনোদ মেটা-কে। ঘটনাচক্রে সেই শহরেই রেইডে সামনে থেকে ফোর্সে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে দময়ন্তীকে। এক জন মহিলা হিসাবে বাড়তি ক্ষতির আশঙ্কা এই ধরনের পরিস্থিতিতে তো জড়িয়েই থাকে। এই অবস্থায় একই সঙ্গে অভিযান সফল করা, সহকর্মীদের সাহস দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কঠিন, তাই না?
আশঙ্কাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নির্লিপ্ত জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম)-এর ব্যাখ্যা, “এর থেকে চার গুণ নিরাপত্তাহীনতায় প্রতিদিন অসংখ্য মেয়েকে রাস্তাঘাটে, বাসে-মেট্রোয় ঘুরে বেড়াতে হয়। অভিযানের সময় তবু সঙ্গে সহকর্মী, গার্ডরা থাকেন। সাধারণ মেয়েদের সঙ্গে তো অধিকাংশ সময়ই রাস্তায় কেউ থাকে না। তাঁকে একাই আত্মরক্ষা করতে হয়।”
কিন্তু আরও প্রশ্ন আছে তো!
আইপিএসের চাকরিতে এত অল্প বয়সে এত উঁচু পদে পৌঁছে যাওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ পুরুষ-ইগো সমস্যা করেনি?
সোজা উত্তর, “করেনি যে তা নয়।” এখনও কোনও চাকরিতে একটি মেয়ে তাঁর পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে বা এগিয়ে গেলে তাঁকে কিছু বাধা সামলাতেই হবে। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে কাজটা করে গেলে কেউ আটকাতে পারবে না,” বলেন দময়ন্তী।
এ তো গেল কাজ।
তার বাইরে ঘরোয়া এক দময়ন্তীও আছেন। যাঁর স্বামী অধ্যাপক। দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। কিন্তু এই প্রসঙ্গটাই তাঁর কাছে ‘টু পার্সোনাল।’ শুধু জানান, প্রিয়জনেরা তাঁর কাজের ধাঁচের সঙ্গে অভ্যস্থ। ছেলেমেয়েরা জানে, মা পুজোর সময় ছুটি পাবে না বা প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরতে দেরি হবে।
বউমা পুলিশ বলে শাশুড়ি মা একটু বেশি সমঝে চলেন কি?
এই প্রথম জোরে হেসে ফেললেন দময়ন্তী। বললেন, “বাড়ির লোকের কাছে আমি পুলিশ নই। বাড়ির বৌ, মা।” বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটাতেই পছন্দ করেন। গান শোনেন, বই পড়েন।
আর সবচেয়ে তৃপ্ত, সবচেয়ে খুশি হন কোন সময়ে?
এ বার একটুও সময় না-নিয়ে উত্তর, “যখন কেস সলভ করি। আমার কাছে অপরাধীর নাম, পরিচয় কিচ্ছু ম্যাটার করে না। অপরাধীর বিরুদ্ধে আমাদের কেস চলছে। সেখানে অপরাধীর দোষ প্রমাণ করে শাস্তি পাওয়াতে হবে। এটাই আমার পাখির চোখের টার্গেট। এটা করতে না পারলে সবচাইতে বেশি হেরে যাওয়ার অনুভূতি হয়।”
দময়ন্তী এর পরেও বলবেন আপনার জীবনটা একেবারে ইন্টারেস্টিং নয়? |
|
|
|
|
|