|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
অরণ্যে দিন-রাত্রি
শালবনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেললে ক্ষতি কী?
জঙ্গলের মধ্যে আরও খানিক ঘুরে নেওয়া যাবে।
লিখছেন সুচন্দ্রা ঘটক |
|
শালবনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বৃষ্টি।
বর্ষাকাল নয়। সঙ্গে নেই ছাতা। দৌড়ে লাভ নেই। বনের মধ্যে রাস্তা খুঁজে বেরোতে বেরোতে সময় লাগে। ততক্ষণে ভিজে যাবেনই সক্কলে।
তবু ব্যস্তবাগীশেরা ছোটেন। শহুরে স্বভাব তাড়িয়ে বেড়ায় যে!
খেলতে বেরনো ছোট্ট ছেলেগুলো খিল খিল করে হাসে। বৃষ্টিতে ভয় কী?
হাসলেই হল! বৃষ্টিভেজা জঙ্গলে সাপখোপ বেরোয়। এখন দুপুর, তাতে কী? রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে অন্ধকার হয়ে যায় যদি?
ও ভাই, তোদের গ্রাম কোথায়? কাছেই?
ওই তো, ডান দিক দিয়ে হেঁটে যাও। ভাল্কি গ্রাম আমাদের।
|
|
ও হরি, তার কাছ থেকেই তো এলাম। সে তো এখনও অনেকটা। ইশ, গাড়ি নিয়ে এলেই হত।
তবু আস্তানা তো চাই। ছুটিতেও তাই ছোটেন তাঁরা।
একটু দূরে অবাক হওয়া ছেলেদের দল। তাদের হাসিতে যোগ দেয় আরও চার জন।
পালিয়ে যাওয়াদের সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে তাদের। ওই দলের ছেলেমেয়েরা জঙ্গলের কাছে ‘রুইনস্’ দেখতে পেয়েছিল। তারই সন্ধানে বৃষ্টির দুপুরে পায়ে পায়ে এখন অরণ্যে এসেছে ওরা।
কিছুটা ইতিহাস। লোকে বলে, বাকি অনেক কিছুই ‘মিথ’। সব মিলিয়ে ধোঁয়াশাময় আবহ ধরে রাখে এই অরণ্য।
বহু যুগ আগে বর্ধমানের এক রাজা শিকার করতে আসতেন এই জঙ্গলে। সঙ্গে আসত তাঁর বাহিনীও। সে সময়ে এখানে অনেক ভাল্লুক ছিল বলে জানেন আশপাশের বাসিন্দারা।
যখন-তখন তো দেখা পাওয়া যেত না ভালুকের। অপেক্ষা করতে হত অনেকক্ষণ। অপেক্ষার সময়টা ভাল ভাবে কাটানোর জন্য দিন দিন আরও ভারী হতে থাকল রাজার শিকারে যাওয়ার দল। তখনই সেই রাজার মনে হল, শিকারের জন্য একটা মাচা তৈরির কথা। সঙ্গীসাথীদের নিয়ে সেখানে বসেই ভাল্লুকের জন্য অপেক্ষা করবেন তিনি। দূর থেকে শিকারকে দেখতেও পাওয়া যাবে উঁচু মাচায় বসে। আবার অন্য কোনও প্রাণী এসে আক্রমণ করতে পারবে না শিকারী দলটিকে।
তার পরেই অরণ্যের মধ্যে ভাল্লুক শিকারের জন্য তৈরি হল মাচা। তার থেকে জায়গার নাম হল ‘ভাল্কিমাচান’। |
|
অরণ্য এখন আর তেমন ঘন নয়। ভাল্লুকও সেখানে আর নেই বলেই জানেন স্থানীয়েরা। শালবনকে দু’ভাগ করে বেশ কিছু কাল আগেই তৈরি হয়েছিল পাকা রাস্তা। এখন রাস্তার এক দিকে গড়ে উঠেছে জনবসতি। ওপারের অরণ্যও এখন তাই তেমন ভয়ঙ্কর নয়। ওই বনের এক কোণে দেখা যায় সেই মাচার ভগ্নাংশ। ওই কিশোর-কিশোরীদের দেখা সেই ‘রুইনস্’ আর কী! আর রয়ে গিয়েছে জায়গার নামটা।
বাকি ইতিহাসের নানা বাঁক শোনা যায় স্থানীয়দের মুখে মুখে। পাড়া থেকে পাড়ায় বদলে বদলে যায় রাজার নামটা। কেউ কেউ তাঁকে জানেন ভাল্কি রাজা নামেই। গুলিয়ে যায় রাজার শাসনকাল। কেউ আবার বলেন, ভাল্কি রাজা নয়, শিকারে যেতেন তাঁর বাবা। মাচাটাও তাঁরই বানানো। এই জায়গায় এসে বাবা কুড়িয়ে পান এক শিশুপুত্রকে। সেই শিশুই পরবর্তীকালে রাজত্ব সামলায়। এই জায়গার নাম থেকে লোকে তাঁকে ডাকত ভাল্কি রাজা নামে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই ওই ইতিহাসের ভগ্নাংশের সামনে পৌঁছয় চার জনের দলটা। অরণ্যের মধ্যে তা খুঁজে পেতে বেশ কিছুটা সময় গিয়েছে তাদের। রোজের ডেডলাইনে বাঁধা অ্যাসাইনমেন্টের গণ্ডি থেকে এই জায়গাটা খুব বেশি দূরে না হলেও এত ক্ষণে অরণ্য তাদের সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে আরও অনেকটা। ইতিহাসের অনেকগুলো পাতা পেরিয়ে অরণ্যে এই এক দিন যদি আরও কিছু সময় গড়াত, তাতে মোটেই দুঃখ পেত না ওই দলের এক জনও।
মাচার ভাঙা অংশের সামনেই অন্য কিছুর ভগ্নাবশেষ। কীসের, তা ঠিক বোঝা যায় না। স্থানীয় ভাল্কি গ্রামের কেউ কেউ বলেন, রাজপ্রাসাদ থেকে মাচা পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করিয়েছিলেন ভাল্কি রাজা। এটা সেই সুড়ঙ্গেরই প্রবেশপথ।
বৃষ্টি থেমেছে। শালবনে এ বার গন্তব্যহীন ঘোরাঘুরি। অনেক দূর যাবে তারা জঙ্গলের পথ ধরে। আর যদি পালিয়ে যাওয়াদের ভয় সত্যি হয়। শালবনের মধ্যে তারা গুলিয়ে ফেলে পথ। ক্ষতি কী? জঙ্গলের মধ্যে আরও খানিক ঘুরে নেওয়া যাবে। |
|
তবে পথ হারানো হয়নি। অথবা সত্যিই পথ হারিয়ে ফেলেছিল ওরা। তাই গভীর অরণ্যে আর যাওয়াই যায়নি। বরং ভিজে মাটির পথ ধরে ওরা পৌঁছে গিয়েছে ভাল্কি গ্রামের পুরনো এক মন্দিরের সামনে। আর দু’পা এগিয়ে দেখা মেলে আরও এক মন্দিরের। তার পরে আরও একটা। তার পরে আরও আরও।
শোনা যায়, এই অঞ্চলে শিবের ১০৮টা মন্দির তৈরি করেছিলেন এক রাজা। সব ক’টা এখন আর নেই। ভাঙা মন্দিরগুলো ঘিরেই গড়ে উঠেছে জনবসতি। সেই মানুষজনের মুখে আরও কত ইতিহাস এক-একটা মন্দির নিয়েই। ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে দুপুর থেকে অনায়াসেই সন্ধ্যা। মাসির ঝুপড়িতে বিকেলের চা-বেগুনি, জিলিপিতেও সঙ্গী থাকে ভাল্লুক-রাজা-শিবমন্দিরই।
ভাল্কিমাচানের আস্তানা সেখান থেকে বেশ খানিকটা পথ। দু’ধারে সন্ধের শালবন ঘেরা রাস্তা পেরিয়ে আলো-ঝলমলে রিসর্ট। সাজানো বাগানে বসে অরণ্য থেকে পালিয়ে আসাদের কাছে ওই চার জনের ঝুলির সবটাই পর্যটক টানার জন্য তৈরি ‘মিথ’ মাত্র। শান্ত-নিঝুম অপরিচিত পরিবেশে নিজেদের নতুন করে পেতে এখানে এসেছেন যে তাঁরা। শহর থেকে এত কাছে বসেও নিঃস্তব্ধতাকে উপভোগ করতে পারাই যে আসল।
বিতর্ক জমে ওঠে বাহারি আস্তানায় নৌকো বাঁধা সাজানো লেকের পাড়ে বসে।
|
কী ভাবে যাবেন |
সব চেয়ে কাছের রেল স্টেশনের নাম মানকর। সেখানে নেমে ভাড়া গাড়িতে আধ ঘণ্টার রাস্তা। তবে সব ট্রেন থামে না মানকরে। সে ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে যে কোনও ট্রেনে চলে যাওয়া যায় বর্ধমান। সেখান থেকে ভাল্কিমাচানের গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। বর্ধমান থেকে মানকর পর্যন্ত বাসও যায়। কলকাতা থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে যেতে হলে ধরতে হবে দু’নম্বর জাতীয় সড়ক। গালসি থেকে ডান দিকে কিছুটা গিয়েই মানকর। |
|
কোথায় থাকবেন |
পর্যটকদের কাছে এখনও খুব পরিচিত নয় বলে সেখানে খুব বেশি থাকার জায়গা নেই। স্থানীয় একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে চালানো হয় একটি রিসর্ট। আর কাছাকাছি একটি স্বনির্ভরগোষ্ঠী চালিত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। |
|
সঙ্গে রাখবেন |
মানকর থেকে ভিতরে চলে এলে দোকানপাট নেই। তাই প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে যাওয়া ভাল। টর্চ এবং মশার ধূপ রাখা জরুরি। |
|
|
ছবি: পারমিতা দে। |
|