সিনেমা সমালোচনা...
২২ গজে প্রসেনজিতের মস্তানি
শেষ কথা দিয়েই শুরু করি। ‘২২শে শ্রাবণ’ ছবিটা যদি এখনও না দেখে থাকেন তা হলে অবশ্যই দেখবেন। উৎসবের এই ভরা মরসুমে ছবিটা, তার নিজের সংলাপের ভাষায়খাপে খাপ। সেই জন্যই, ছবিটা কা’কে নিয়ে দেখতে যাবেন সেটা একটু ভেবে নেবেন। না না, চুমোচামা তেমন কিছু নেই। যেটুকু আছে তা আজকের অনুপাতে জলভাত। তেমন কাউকে নিয়ে এ ছবিটা দেখতে না যাওয়ার কারণ চোখ নয় কান। চরিত্রদের অনেকেই পুলিশতাঁদের মুখে চার অক্ষরের ‘বোকা-’ সবচেয়ে নিরীহ গালাগালি। তবু দশে আট। নাহ! ওটাকে সাড়ে আট করুন। ‘২২শে শ্রাবণ’-কে এর কম দেওয়া যায় না।
কেন সে কথা বোঝাতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে সংলাপের কথা। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় সংলাপ নিজেই লিখেছেন এবং বেড়ে লিখেছেন। স্মার্ট সংলাপ অনেক আছে তবে যেটা চট করে মনে পড়ছে সেটাই লিখি। বয়সে এবং পদমর্যাদায় সিনিয়র রাশভারী এক পুলিশ অফিসারের বাড়ি গেছেন এক অল্প বয়সি তত সিনিয়র নয় অফিসার। শিভাস রিগ্যালে চুমুক দিতে দিতে সিনিয়র বললেন, “হুইস্কি চলে?” জুনিয়র আমতা আমতা করে, “না। ডিউটিতে তো একদমই না...।” মাঝপথে ওকে থামিয়ে অসাধারণ কমিক টাইমিং নিয়ে সিনিয়র শুধান ‘‘বোর্নভিটা?”
ছবি হোক বা উপন্যাস রহস্য রোমাঞ্চের জগতে বুদ্ধি বস্তুটি বড় বেশি জরুরি। কে খুনি চেনা যাচ্ছে না সেটা বড় কথা নয়। চেনা খুনিকে শনাক্ত করার যুক্তিগুলো কতটা বুদ্ধিনির্ভর তার থেকে কাহিনির জাত চেনা যায়। সঙ্গে দেখা হয় খুনির মনস্তত্ত্ব কতটা যুক্তিগ্রাহ্য। সৃজিত এই দুই ব্যাপারেও ডিসটিংশন নিয়ে পাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়কাহিনি বুনেছেন এমন এক শাড়ির আঁচলে যার নাম বাংলা কবিতা। শুধু চেনা ‘বনলতা সেন’ বা ‘ঝলসানো রুটি’ নয়মাইকেল, বিনয় আর শক্তিও আছেন।
রহস্য গল্প বলে দিতে নেই। ছবি দেখার আগে শুধু এইটুকুই জানুন যে কলকাতা শহরের রাস্তায় একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছে কোনও প্যাটার্ন নেই। পুরুষ বা মহিলা, ভিখিরি বা বেশ্যাকোনও বিশেষ ধরনকে খুন করা হচ্ছে না। একটাই যোগসূত্রপ্রত্যেক খুনের জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে এক-এক জন বাঙালি কবির লেখা বিখ্যাত কবিতা। পুলিশ পারছে না। এক অসম্মানিত এবং বহিষ্কৃত পুলিশ অফিসারের সাহায্য চাওয়া হল। ব্যাস এইটুকুই থাক। বাকিটা হলে গিয়ে।
২২শে শ্রাবণ
প্রসেনজিৎ, গৌতম, পরমব্রত, আবির, রাইমা
সৃজিতের ছবি বানানোর মুনশিয়ানা ‘অটোগ্রাফ’-এই প্রমাণিত। সৌমিক হালদারের ফটোগ্রাফি অসাধারণ। সৃজিতের ভাবনাকে জীবন্ত করতে ওঁর অনেকটা হাত আছে। সৃজিত যে ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’ নন, তিনি যে আধুনিক বাংলা সিনেমার লব্ধ প্রতিষ্ঠিত পরিচালকদের পাশে নিজের জায়গা করার দাবিদার, সেটা আবার উনি মনে করিয়ে দিলেন। তবে, দু’টো ছবির পর ঋতুপর্ণ, অপর্ণা, অঞ্জন বা গৌতমের পাশে সৃজিতকে জায়গা দিতে বললে অনেকেই হয়তো ইতস্তত করবেন। বলবেনজুরি ইজ স্টিল আউট। তবে বিষয়বৈচিত্রে দু’টো ছবি দিয়েই উনি অনেকটা আকাশে রং লাগিয়ে দিয়েছেন। বেশি দিন জুরিরা আউট থাকবেন না বলেই মনে হয়।
এই ছবির পরম সম্পদ পরম। এক মেধাবী কিন্তু অব্যোমকেশীয় পুলিশ-গোয়েন্দার চরিত্রে উনি অসাধারণ। উনি আর এক বার মনে করালেন যে অভিনয়ের মানে হয়তো বা ‘যা নয় তাই’। পরমের করা পুলিশের নাম অভিজিৎ। সে তোপসে থেকে কয়েক যোজন দূরে। সকালের কাগজের খুচরো পাতায় বা টিভির হালকা অনুষ্ঠানে গিটার হাতে যদি পরমকে দেখে থাকেন তা হলে বুঝতে পারবেন পরমকে কতটা বদলে অভিজিৎ হতে হয়েছে। ঝাঁকুনি ছাড়া এই দূরত্বটা হাঁটাটাই তো অভিনয়। রাইমাকে মানিয়েছে ভাল এবং চরিত্রটাকে খুব
জীবন্ত করেছেন কোনও রকম ন্যাকামির সাহায্য ছাড়া। শুধু সুন্দর চোখ দু’টো তুলে তাকানো ছাড়াও দারুণ সংলাপ বলেছেন। চরিত্রটিতে একটা
ব্যক্তিত্ব এনেছেন। আবিরকে ভাল লাগে। খুব স্বাভাবিক অভিনয়ের জন্য। বিশেষত রাইমাকে প্রোপোজ করাটা ২০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দৃশ্যে। অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা পুলিশ অফিসারের চরিত্রটি নজর কাড়ে।
এই ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিবারণ চক্রবর্তীর। রবীন্দ্রনাথ আর নিবারণ চক্রবর্তীর ধাঁধাটা খুবই আকর্ষণীয়। গৌতম ঘোষচেহারার দিক থেকে নিবারণ চক্রবর্তীর চরিত্রের সঙ্গে খুব মানানসই। এই চরিত্রটি ঠিক রোজ সকালে অফিস যাওয়ার পথে মেট্রোয় দেখা মানুষের মতো নয়। বইমেলায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে জেলখাটা চরিত্র। এই চরিত্রের অনুভূতির চরম মুহূর্তগুলোতে গৌতমবাবুর অভিনয় দেখে বোঝা যায় না যে, এর আগে মাত্র একটা ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। তাও প্রায় কয়েক দশক আগে। ওঁর কন্ঠস্বর গভীরসুন্দর আবৃত্তি করেছেন।
প্রসেনজিৎ হয়েছেন প্রবীরএই ছবির অন্যতম মুখ্য চরিত্র। সংলাপের গুণেঅথর-ব্যাকড চরিত্র। প্রসেনজিৎ কেমন করেছেন? ওঁর ভক্তরা খুব খুশি। দক্ষিণের নামী মাল্টিপ্লেক্সে ছবি চলছে। প্রায় প্রত্যেক চটকদার সংলাপের পরে দর্শকরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হাততালিতে ফেটে পড়ছেন। এই অভিজ্ঞতা এর আগে কোনও ছবিতে হয়নি আমার।
প্রসেনজিতের ভক্তরা নিঃসন্দেহে খুশি। পত্র-পত্রিকা থেকে জানা যায় যে প্রসেনজিৎ এখন আর ‘পোসেনজিত’ থাকতে চান না। উনি এখন মনে রাখার মতো চরিত্র করার চেষ্টা করছেন এবং করবেন। এ ছবি দেখলে মনে হবে যে ওঁর একটা বাড়তি বোঝা আছেনায়ক প্রসেনজিৎ বনাম অভিনেতা প্রসেনজিতের লড়াই। মনে রাখার মতো অভিনয় করার ওঁর এই প্রয়াসে এটা একটা দেওয়াল হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সব চরিত্র তো আর ‘অটোগ্রাফ’-এর মতো হয় না। এত কিছু বলা সত্ত্বেও এটা না বললে অন্যায় হবে যে এই সমস্যা নিয়েও উনি কিন্তু ‘২২শে শ্রাবণ’-এ ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন।
খুঁত কি নেই তা হলে? কেন থাকবে না? চাঁদেও আছে ‘২২শে শ্রাবণ’-এও আছে। সাধারণত রহস্য উপন্যাস বা রহস্য সিনেমা মেদহীন হয়। জটায়ুরা থাকেন রিলিফ হিসেবে কিন্তু অনুসন্ধানের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে। এ ছবিতে একটা ‘লিভ ইন’ প্রেম আছে। বরফের পাহাড়ের পটভূমিকায় গান
গাওয়া আছে। রাইমার গ্ল্যামারও ভাল করে ব্যবহার করেছেন সৃজিত। এর ওপর আছে এক আবছা ত্রিকোণের ইঙ্গিত। এ সবের সঙ্গে মূল রহস্যের যোগাযোগ কিন্তু ক্ষীণ। তাতে কী হয়েছে? পরম আর রাইমার আদর করার কিছু দৃশ্য কিন্তু মারকাটারি।
আর কিছু কিছ অসঙ্গতির কথা না বললেই নয়। প্রসেনজিতের চরিত্রের অভিনয়ের আভিজাত্যের সঙ্গে অকথ্য গালাগালি একটু বেজোড় থেকেছে। বহিষ্কৃত পুলিশ অফিসার কী করে নিয়মিত শিভাজ রিগ্যাল খায় সেটা নিয়েও ধন্দ থেকে যায়। প্রবীরের প্রথম দিকের অগোছালো চেহারা, চাকরি ফেরত পাওয়ার পর হঠাৎ ঝাঁ চকচকে নায়কোচিত হয়ে যায়। তাই ওঁর মেকআপ আর চেহারা নিয়ে একটা ধাঁধা থেকেই যায়। আর পরমের ফ্ল্যাট যেখানে ও চুটিয়ে প্রেম করে, সেটা যে, কোনও মাল্টিন্যাশনালের বড় এক্সিকিউটিভের বাসযোগ্য। ঘুষের টাকায় করাএমন কোনও ইঙ্গিত কিন্তু পরিচালক দেননি। এ ছবির গান রিলিজের আগে থেকেই জনপ্রিয়। অনেকেই ছবিটা গান শুনে দেখতে যাবেন। কিন্তু কোনও ক্রাইম থ্রিলারেই গানের ভূমিকা সন্দেহজনক। এ ছবিতেও তাই গান সারাক্ষণ বলে গেছে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। এ ছবির আবহ তৈরিতে সঙ্গীত তেমন প্রভাব ফেলেছে বলে ঠাহর হয় না।
রহস্যের ছবি। টানটান উত্তেজনার ছবি। তবু সেরা কিছু বাছতে দিলে ব্যোমকেশীয় কিছুকে বাছব না। জয়েন্ট ম্যান অব দ্য ম্যাচ করতে হবে। প্রথম দাবিদার একটা দৃশ্যপরম আর রাইমার ঝগড়া। দেখাসাক্ষাৎ নেই। পরম হঠাৎ রাস্তায় নেমে দেখে আবির আর রাইমা রাস্তায় ঘনিষ্ঠ ভাবে হাঁটছে। তাই বাড়ি ফিরে নেশা আর নেশার ঘোরে মনে মনে পরম যায় ওদের খোঁজে নানাখানে। সেই দৃশ্যে পরম দেখে ময়দানে আবির রাইমার মতো একই রকম জামাকাপড় পরা অনেক দম্পতি। পরম খোঁজে, পালায়, ওদের কাছে তাড়া খায় খুব বাঙ্ময় দৃশ্য। মনে থেকে যায়।
আর ম্যান অফ দ্য ম্যাচের দ্বিতীয় দাবিদার কবিতা পড়া। যাঁরা শব্দ ছন্দের যুগলবন্দি ভালবাসেন, যাঁরা ভাবনার গভীরে ডুব দিয়ে আনন্দ পানতাঁরা সারা ছবিতে পরের খুনটার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবেন। আরও একটা ভালো কবিতা শোনার আশায়।
অবশ্য প্রসেনজিৎ, সৌমিক আর সৃজিতের দৌলতে সারা ‘২২শে শ্রাবণ’ই এক রহস্য কবিতা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.