|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
সামাজিক দায়বোধ থেকে মানবিক প্রতিবাদ |
সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল চিত্তপ্রসাদের একক প্রদর্শনী। লিখছেন
মৃণাল ঘোষ। |
প্রখ্যাত শিল্পী চিত্তপ্রসাদের সামগ্রিক কাজ নিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। এর উদ্যোক্তা দিল্লি আর্ট গ্যালারি। তাঁরা বহু দিন থেকে এই শিল্পীর কাজ সংগ্রহ করেছেন। পঞ্জীকৃত করেছেন। তার পর অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাবে জনসমক্ষে উপস্থাপিত করলেন। এর আগে প্রদর্শনীটি দিল্লিতে হয়েছে। তার পর কলকাতায়। একে বলা হচ্ছে এই শিল্পীর প্রথম পূর্বাপর প্রদর্শনী। কিন্তু এর আগেও কলকাতায় তাঁর বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ দেখানো হয়েছে। যদিও এত বড় মাপে ও সুপরিকল্পিত ভাবে নয়।
চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য ভারতের আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৯৪০-এর দশকে আধুনিকতার যে নতুন ধারা জেগেছিল তা অনেক প্রশাখায় বিভক্ত। তার একটি হল সামাজিক দায়বোধ থেকে মানবিক ও প্রতিবাদী এক চিত্রধারা গড়ে তোলা। চিত্তপ্রসাদ ছিলেন এই ধারার প্রধান এক পথিকৃৎ। আরও যেসব শিল্পী এই সামাজিক রাজনৈতিক দায়বোধ থেকে কাজ করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোর, মণি রায়, সূর্য রায়, লক্ষ্মী রায়, দেবকুমার রায়চৌধুরী, হেমন্ত দাস, পল্লব রায়চৌধুরী, রাণু পাকড়াশি, খালেদ চৌধুরী, দেবব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিবাদ থেকে জেগে উঠেছিল এঁদের ছবি। এদের অনেকের কথাই দেশ মনে রাখেনি। চিত্তপ্রসাদের কথাও না। অনেক যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্য দিয়ে চিত্তপ্রসাদ তাঁর শেষ জীবন কাটিয়েছেন। ১৯৫৯ সালের ২৬ জুন তাঁর বন্ধু মুরারি গুপ্তকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন : “কী অপমান আর যন্ত্রণায় দিনরাত নিজের ক্ষয় অপব্যয় দেখছি কী করে জানাই তোমায় ভাই মুরারি? অথচ আমি বিনা অহঙ্কারেই বলছি বহু ঐশ্বর্য আমি দিয়ে যেতে পারতাম, এখনও পারি এ দেশের শ্রীচরণে। এরা নিতে জানে না, কারণ দিতে জানে না।”
|
|
শিল্পী: চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য |
তবু তিনি যা দিয়ে গেছেন তার মূল্যও যে কিছু কম নয় তা বোঝা গেল এই প্রদর্শনী দেখে। এখন সচেতনতা জাগছে এই শিল্পীর অবদান সম্পর্কে। সম্প্রতি প্রকাশ দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘চিত্তপ্রসাদ’ নামে বাংলায় একটি তথ্যসমৃদ্ধ বই। আলোচ্য প্রদর্শনী উপলক্ষেও শান্তিনিকেতন কলাভবনের অধ্যাপক ড. সঞ্জয়কুমার মল্লিকের নিবিষ্ট গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে শিল্পীর জীবন ও কাজের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ইংরেজিতে পাঁচটি সুপরিকল্পিত গ্রন্থ।
আমরা চিত্তপ্রসাদের ছবি পাচ্ছি তাঁর চট্টগ্রাম পর্ব থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই তাঁর অবস্থান চট্টগ্রামে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ১৯৪১ সালে। চল্লিশের দশকের গোড়ায় চট্টগ্রামে অবস্থানকালে তিনি এঁকেছেন সাধারণ জীর্ণ, বিপন্ন মানুষের ছবি। পার্টির পোস্টারও এঁকেছেন সেই সময়ে। চট্টগ্রাম থেকে তিনি কলকাতায় আসেন। অজস্র ধারায় ছবি আঁকতেন। ১৯৪৩ সালে তাঁকে যেতে হল মেদিনীপুরে। দুর্ভিক্ষ ও বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষের ছবি এঁকেছেন সেখানে। সেই সময়ের দুর্বিষহ বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বিবরণ সহ ‘হাংরি বেঙ্গল’ বইটি প্রকাশ করেন।
এই প্রদর্শনীতে যে ছবি দেখতে পাই তাতে স্বশিক্ষিত এই শিল্পীর বাস্তববাদী রূপায়ণে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। কালি-কলমে আঁকতেন ছোট ছোট রেখা। ১৯৪৪ সালের মার্চের গোড়ায় ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকায় ছবি আঁকার জন্য তাঁকে মুম্বইতে নিয়ে আসা হয়। সেই থেকে জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত মুম্বইতেই তিনি থেকেছেন ও কাজ করেছেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এলেন ১৯৪৯-এর গোড়ায়। ১৯৫২ সাল থেকে অন্য মাধ্যমের পাশাপাশি ছাপচিত্র চর্চায় নিবিষ্ট ভাবে মনোনিবেশ করেন। মূলত কাঠখোদাই ও লিনোকাট এই দুটি মাধ্যমেই তিনি কাজ করেছেন। এই সময় থেকেই তাঁর ছবিতে আসতে থাকে লৌকিক আঙ্গিকের সারল্য ও আদর্শায়িত সুষমার কল্পনা। ১৯৫৩-এর রঙিন লিনোকাটে একটি শিশুর হাতেখড়ির ছবি বা ১৯৫৫-এর উডকাটে ‘মা ও শিশু’র ছবি এই সুষমার প্রকৃত দৃষ্টান্ত। এর পাশাপাশিই চলছে প্রতিবাদী চেতনার ছবি। ১৯৭১-এ তেলরঙে আঁকা ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ’-এর ছবিটিতে লৌকিকের সঙ্গে কিউবিস্ট এক্সপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকের যে সমন্বয় - তাতে তাঁর গভীর শৈল্পিক প্রজ্ঞা ধরা থাকে। এই প্রদর্শনীতে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে মন্বন্তর থেকে পুতুল তৈরি পর্যন্ত কালানুক্রমিক বিন্যাসে খুবই সুচারু ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর কাজ যা তাঁর মহত্তকে বুঝতে সাহায্য করবে। |
|
|
|
|
|