নীলকণ্ঠের ভাঙা ডানা পড়ে আছে
নেতাইয়ের পথে-প্রান্তে

ল্যামিনেশন করা করা ছবিটার নীচেই ঝোলানো গীতার সারাংশযা হয়েছে ভালই হয়েছে, যা হচ্ছে তা ভালই হচ্ছে, যা হবে তাও ভালই হবে।
ছবিটা অরূপ পাত্রের। বয়স কুড়ি-বাইশ। গীতার সারাংশ ঝুলিয়েছেন রঞ্জিত পাত্র। অরূপের বাবা। ধর্মভীরু লোক। বেদ-বেদান্ত, গুরুদেব, করতাল, খঞ্জনি নিয়ে দিন কাটে। তাঁর ভদ্রাসন কংসাবতীর ধারে। লালগড়ের নেতাই গ্রামে। গাছগাছালিতে ভরা সবুজ একটি গ্রাম।
এই গ্রামেই শীতের এক সকালে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটল। এক দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে। রাজনীতির বিষ ভরা গুলি। একটা গুলি এলে লাগল অরূপের পেটে। গলগল রক্ত। খানিক ছটফটানি। তার পর ‘মা গো’ বলে সুদূর মেঘ-মুলুকের দেশে। পড়ে রইল খেলার মাঠ, দোয়েল-শ্যামার শিস আর নীলকণ্ঠের ভাঙা ডানা। শুধু কি অরূপ? কংসাবতীর তীরে পর পর সাতটি চিতা জ্বলল। পরের দিন আরও দু’টি। আপনি এখনও গীতায় বিশ্বাস করেন, যা হয়েছে ভালই হয়েছে? গুরুদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে একটু ভাবনায় পড়েন রঞ্জিতবাবু। ঘরের মধ্যে বার দুই পায়চারির পরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন মেঝেতে। বলেন, “আমি একটা হারমোনিয়াম কিনেছি বুঝলেন। নতুন হারমোনিয়াম। ছেলের মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম। সেই টাকায়।”
আমি তো বলছিলাম, আপনি কি বিশ্বাস করেন, যা হয়েছে...?
শুনুন না, আমি হারমোনিয়াম বাজাতে পারি না। কোনওদিন বাজাইনি। আমার স্ত্রীও বাজাতে জানেন না। আপনি পারলে একটু বাজান না। ক্ষতি কী!
আমি তো বলছিলাম, আপনি এখনও বিশ্বাস করেন যা হয়েছে...?
হারমোনিয়ামে একটা গমগম আওয়াজ হয়। জোরে টানলে আরও আওয়াজ, যত টানবেন তত আওয়াজ। আমি সারেগামা জানি না। কিন্তু জোরে টানতে পারি। জোরে আওয়াজ হলে আমি কিছু আওয়াজ ভুলে থাকি।
কী আওয়াজ?
একটা কোলাহলের আওয়াজ, কিছু গুলির আওয়াজ, আমার ছেলের গোঙানির আওয়াজ। মৃত্যুর আগে হতভাগাটা খুব কষ্ট পেয়েছিল। আওয়াজ করছিল। কী করে বলি, যা হয়েছে ভালই হয়েছে! কী করে বলি! তরতাজা ছেলে আমার। আমি ওকে কিচ্ছু দিতে পারিনি। আমি অপদার্থ, অকর্মণ্য। এই হারমোনিয়ামটাও কিনেছি ছেলের রক্তের টাকায়।
মাথার চুল দু’হাত দিয়ে খামচে ধরেন রঞ্জিতবাবু।
তাঁর বাড়ির সামনে কাদা প্যাচপেচে রাস্তা। এদিক-ওদিকে কলমির গন্ধ ভরা পুকুর। রাস্তার ধারে বুড়ো বটের ঝুরি। চৌদিকে পিলপিল করছে মুরগির ছানা। মাঠের মাঝে বিদ্যুতের তার। তাতে লেজ নাড়াচ্ছে নীলকণ্ঠ পাখি। পথের ধারে হরিমন্দির। পাড়ার পুজো মণ্ডপ। খানিক এগোলেই সরস্বতী ঘরাইয়ের বাড়ি। মাটির ঘরে একলা বসে সরস্বতীর মেয়ে শ্রাবণী। গত বার মাধ্যমিক দিয়েছিল। পাশ করেনি। পরীক্ষা খারাপ হল কেন?
মায়ের মাথার খুলিটা গুলিতে উড়ে গিয়েছিল। দু’ভাগ। পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে পারিনি। শুধু কান্না পেত।
সে দিন বাবা-মা দু’জনেই কি ওই দোতলা বাড়িটার সামনে গিয়েছিলেন? বাবা মোষের গাড়ি চালায়। খড় আনতে গিয়েছিল। গ্রামের বহু লোকই সে দিন ওই দোতলা বাড়ির সামনে প্রতিবাদ জানাতে যান। যখন গুলি চলে, মা তখন গোবর জমাচ্ছিল। গুলির শব্দে মা ছুটে যায়। তখন ওখানে প্রচুর লোক। মাকে দেখে কেউ এক জন নাকি বলে, দে, দে, এই মেয়েছেলেটাকেও শেষ করে দে। তার পরেই গুলি। তার পর নদী পেরিয়ে ওরা ওপারে চলে যায়।
শ্রাবণীর ঘরের দেওয়ালে অজস্র ছবি। দেব, কোয়েল, শুভশ্রীর। এগুলো কে কিনেছে? তুমি?
আমিই কিনেছি। মা পয়সা দিয়েছিল। রথের মেলায় জিলিপি খেতে। পুজোর মতো রথের মেলাও খুব বড়। মেলার পয়সা জমিয়ে ছবি কিনেছি। এই দেওয়ালটা মা রোজ মাটি লেপে দিত। ডেকে ডেকে খাওয়াত। এই যে জামাটা দেখছেন, এটাও মায়ের কিনে দেওয়া। গতবার পুজোয়। লালগড় বাজার থেকে। বাবার সঙ্গে তো অত কথা হয় না। মা-র সঙ্গেই কথা হত। কত কথা। মা গো!
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শান্তনু ঘরাই। শ্যামানন্দ ঘরাইয়ের ছেলে। দোতলা বাড়ির গুলি বুক ফুঁড়ে চলে যায় শ্যামানন্দের। শান্তনু বলেন, “আমাদের গ্রামে ঘাসে ঘাসে রক্ত। কিন্তু এমন তো ছিল না। চাষবাস নিয়ে বেশ ছিলাম আমরা। পুজোয় হইহই হত। শহরের মতো অত বড় পুজো নয়। কিন্তু হতো তো! এ বারও হচ্ছে। তবে সবাই কেমন ঝিমিয়ে। গ্রামে তো রক্তের দাগ লাগেনি কখনও।”
শ্রাবণীদের উঠোন পার হয়ে খড়ের গাদা। তার পর আরও কয়েকটি বাড়ি। তারই একটিতে থাকেন শক্তিপদ ঘরাই। বাড়ির সামনে গোয়াল। সেখানে কাঠ জ্বলিয়ে রান্না করছিলেন শম্পা ঘরাই। নিহত সৌরভের স্ত্রী। শক্তিপদবাবু সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। অবসর নিয়েছেন। কোথায় গুলি লাগলে কী হয়, তা বিলক্ষণ জানেন। বললেন, “যখন শুনলাম ছেলের পিঠে লেগেছে শিউরে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়। দেখলাম ছেলে মাটিতে লুটোচ্ছে। শরীরটা নেড়েঘেঁটে দেখলাম। সাড় নেই। নাড়ি দেখলাম। মনে হল, নাড়ি চলছে। বুকে হাত দিলাম। মনে হল, ধকধক করছে। আসলে কিছুই চলছিল না। সবই আমার মনে হচ্ছিল। শুধুই মনে হচ্ছিল। অন্য কিছু যে মনে আসছিল না। বাবা তো আমি!” আড়াই বছরের নাতিটার হাত আঁকড়ে ধরেন শক্তিপদবাবু।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.