নির্বাচনী বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র লক্ষ্যে বামফ্রন্টের অন্দরে পথ খোঁজার চেষ্টা আরও গতি পেতে চলছে পুজো মিটতেই।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংগঠনকে ঢেলে সাজার জন্য কর্মসূচি ঠিক করতে পুজোর পরেই আগামী সপ্তাহে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বিশেষ বৈঠক এবং রাজ্য কমিটির দু’দিনের অধিবেশন বসছে। গণ-সংগঠনগুলিকে নতুন করে সাজানোই তিন দিনের ওই আলোচনার লক্ষ্য। পাশাপাশি, বামফ্রন্ট পরিচালনার পদ্ধতি নিয়েও কিছু প্রস্তাব ওই বৈঠকে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা। আগামী ৯ নভেম্বর থেকে সিপিএমে যখন লোকাল কমিটি স্তরে সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা, সেখানে ফব-র লক্ষ্য ডিসেম্বরের মধ্যে সংগঠন পুনর্বিন্যাসের কাজ সেরে ফেলা।
বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে বামফ্রন্টের দলগুলির মধ্যে ফব-র কেন্দ্রীয় কমিটিই একমাত্র, যারা লিখিত প্রস্তাবে বলেছিল, ফ্রন্টের নেতৃত্ব বদলানো উচিত। নিজের দলের ক্ষেত্রেও ওই প্রস্তাব কার্যকর করার কথা বলেছিলেন ফব নেতৃত্ব। কিন্তু নিজেদের দলের সম্মেলন প্রক্রিয়ার আগে নেতৃত্ব বদলের দাবি বিবেচনায় আনেননি সিপিএম নেতৃত্ব। কিন্তু বিধানসভা ভোটে বিপর্যয় এবং তার পরে সাম্প্রতিক দু’টি উপনির্বাচনে আরও ভরাডুবির পরে ফব-র একাংশের অভিমত, সিপিএমের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ এখন একেবারেই তলানিতে। এই পরিস্থিতিতে সর্বত্র সিপিএমকে সামনে রেখে বামফ্রন্টের পক্ষে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ মুশকিল। ফব-র কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “সিপিএম বড় দল, তাদের সংগঠন অনেক বিস্তৃত। তারাই বামফ্রন্টের সার্বিক নেতৃত্বে থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত সাময়িক ভাবে কয়েকটি জেলায় বামফ্রন্টের রাশ ফব বা আরএসপি-র মতো শরিক দলগুলির হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। দলে আলোচনা করে অনুমোদন পেলে এই প্রস্তাব বামফ্রন্টে জানানো যেতে পারে।” শক্তিশালী সংগঠনের নিরিখে কোচবিহার, পুরুলিয়ায় ফব, দক্ষিণ দিনাজপুরে আরএসপি এই রকম কিছু জেলায় শরিক দলের হাতে ফ্রন্টের নেতৃত্বের ভার ছাড়ার প্রস্তাব নিয়েই দলে আলোচনা করতে চায় ফব-র একাংশ।
ফব-র প্রবীণ রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের মতে, “দলকে রক্ষা করতে গেলে গণ-সংগঠনগুলিকে নতুন করে শক্তিশালী করা দরকার। গণ-সংগঠনগুলি যাতে আরও বেশি করে মানুষকে সামিল করতে পারে, সেই দিকে নজর দেওয়া দরকার। সাংগঠনিক কিছু পরিবর্তনের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা করে ফেলতে চাই।” আগামী ১৪ থেকে ১৬ অক্টোবর রাজ্য স্তরের বৈঠকে এই বিষয়গুলি নিয়েই আলোচনা হবে।
দলে আলোচনার পাশাপাশি ফব-র দলীয় মুখপত্রের শারদ সংখ্যাতেও এ বার ‘বামপন্থায় বিচ্যুতি’র উপরে একগুচ্ছ নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে যেমন ফ্রন্টের চারটি প্রধান শরিক দলের তরফে বিমান বসু, দেবব্রত বিশ্বাস, মঞ্জুকুমার মজুমদার, মনোজ ভট্টাচার্যরা লিখেছেন, তেমনই বিশ্লেষণ করেছেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সন্তোষ রানার মতো ফ্রন্টের বাইরের বামপন্থী নেতারাও। ‘বিগত নির্বাচনে কেন হারলাম’ শীর্ষক নিবন্ধে সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুবাবু লিখেছেন, ‘জোটধর্ম অনেক সময়েই পালিত হয়নি। বৃহত্তম দল বামফ্রন্টের সমার্থক হয়ে পড়েছে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই বামফ্রন্ট ও সরকার পরিচালনায় এবং নীতি প্রণয়নে নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়’। পক্ষান্তরে, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু লিখেছেন, ‘বামফ্রন্টের সব শরিক দলের পক্ষ থেকেই আত্মসমীক্ষা করে নিজেদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।... বামফ্রন্টের শরিক দলসমূহের কর্মী ও ঘনিষ্ঠদের একটা অংশের মধ্যে আড়ষ্টতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে এই আড়ষ্ট ভাব কাটাতে আমাদের পরিকল্পিত ভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে হবে’। আর ফব-র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রতবাবুর পরিষ্কার বক্তব্য, নতুন ভাবে বামপন্থা তথা সমাজতন্ত্রের আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে ‘দলের মধ্যে, ভিতরে ও বাইরে আত্মসমালোচনা ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে’, ‘পিছন থেকে ছুরি মারা নয়, খোলামেলা কথা বলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে’। |