পুজোর সপ্তাহখানেক আগে থেকে আর ফুরসত মেলে না গোবারডাঙার গৈপুরের আদিবাসীপাড়ার মহিলাদের। মণ্ডপ থেকে শুরু করে প্রতিমার বায়না দেওয়া, পুজোর বাজার, পুরোহিত ঠিক করা, চাঁদা তোলা সবই করতে হয় তাঁদের। তাঁদের উদ্যোগেই গোটা এলাকা পুজোর ক’দিন আলোর রোশনাইয়ে ভরে যায়।
স্থানীয় আদিবাসী মহিলা সমিতির এই পুজো অবশ্য একেবারেই নতুন। বলতে গেলে সদ্যোজাত। গত বছরই শুরু হয়েছে দশভূজার আরাধনা। পুজোর কয়েকদিন যেন যেন একটা গোটা আদিবাসী গ্রামই উঠে আসে তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে। চলে নিজস্ব ঘরানার নাচ-গান। যার আকর্ষণে এখানে ভিড় করেন বহু মানুষ।
উত্তর ২৪ পরগনার এই গৈপাড়ায় বসবাস করেন ওরাং উপজাতিগোষ্ঠীর ৪৫টি পরিবার। গোটা জেলা যখন থিম পুজোর ভিড়, রকমারি আলোর খেলায় মেতে থাকত, তখন প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতোই পড়ে থাকত এই পাড়া। ৪৫টি-র মধ্যে ১৬টি পরিবারের কেউ না কেউ সরকারি চাকরি করেন। স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর খরচের সিংহভাগ দায়িত্ব থাকে তাঁদের কাঁধে। সহযোগিতায় থাকেন অন্যরা। তবে বাইরের কারও কাছ থেকেই চাঁদা তোলা হয় না। আগে এখানাকার বাসিন্দারা গাছ পুজো করতেন। গত বছর থেকেই সেই রীতি ভেঙে শুরু হয়েছে মূর্তিপুজো।
কিন্তু কেন?
সমিতির সম্পাদক আলপনা সর্দার বললেন, “এই সময় চারদিকে পুজোর গন্ধ। সবাই নতুন জামাকাপড় পরে। আর আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াত। তাই সকলে ঠিক করি ছেলেমেয়েদের আনন্দের কতা ভেবে পুজো করব।” তবে এ জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। আদিবাসী সংস্কার, রীতি, ঐতিহ্যের প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিষয়টির নিস্পত্তি করতে সভা ডাকা হয়। শক্তির দেবীর আরাধনার প্রস্তাব আনেন মহিলারাই। সকলেরই বক্তব্য ছিল, ‘যখন সবাই বছরের এই ক’দিন মায়ের আগমন নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন, তখন আমরা কেন তা থেকে বঞ্চিত হব? তাই আমরাও পুজো করতে চাই’। সকলে একমত হয়ে এর পরেই পুজো শুরু হয়। দিনেশ সিংহ, রমেশ ওঁরাও, অনিল সর্দার, তরুণ ও সমীর সর্দারদের মতো চাকুরিজীবীরাই পুজোর খরচের সিংহভাগ বহন করেন। রমেশ ওঁরাওয়ের কথায়, “দুর্গাপুজোর সঙ্গে আমরা করম পুজোও করি। দুর্গাপুজোর মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করি।”
নবমীর সকালে গিয়ে দেখা গেল, পুরোহিত পুজো করছেন। মণ্ডপের সামনে বাজছে ঢাক। তার ছন্দে নাচছেন আদিবাসী মহিলারা। তাঁদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন পুরুষেরাও। গোটা মণ্ডপ ঘিরে ছড়িয়ে পড়েছে অনাবিল আনন্দ। |