পুজো কর্তাদের ঢাকের আওয়াজে, মণ্ডপে বান ডেকে আনা আলোর রোশনাই-এ, নামীদামি পোশাকে সজ্জিত মানুষের রঙ বেরঙের মিছিলে চাপা পড়ে রয়েছে অপূর্ব বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ ঘোষ ও রাবণ মুর্মুর মতো বহু আটপৌরে যুবকের কথা। বিতর্ক এড়াতে আটপৌরে বলতে হয় তাই! নইলে কৃতকর্মের সৌজন্যে শারদোৎসবের প্রেক্ষাপটে তাঁরাই আসলে বিশিষ্ট। তাঁদের ছাড়া পুজোর কথা অসর্ম্পূণ থেকে যায়।
প্রায় এক যুগ আগে বহরমপুর শহরের জন্য ‘ট্রাফিক ওয়ার্ডেন’ ব্যবস্থা চালু করেন তৎকালীন পুলিশ সুপার রাজেশ কুমার। বিনা পারিশ্রমিকে স্রেফ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে শহরের যানশাসনের জন্য ‘ট্রাফিক ওয়ার্ডেন’ ব্যবস্থা চালু হয়। সেই থেকে ‘ট্রাফিক ওয়ার্ডেন’-এর ২০০ সদস্য বহরমপুর শহরে পুজোর সময়ের জনতার ঢল সামাল দেন সারা রাত।
অপূর্ব বলেন, “ওই ২০০ জনের সবাই নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের সদস্য। তবুও প্রতি বছরের মতো এ বারও কান্দির স্বপন সরকার, বড়ঞার মিঠুন ঘোষ ও ডোমকলের আবু আল মাসাকি-র মতো অনেকেই ৫০ কিলোমিটার থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ পাড়ি দিয়ে বহরমপুরে পৌঁছয় আমজনতার উৎসব নির্বিঘ্নে উতরে দেওয়ার তাগিদ থেকেই।” পরনে পুলিশের মতো খাঁকি ইউনিফর্ম, পায়ে বুট, হাতে লাঠি ও মাথায় হেলমেট। ‘ট্রাফিক ওয়ার্ডেন’-এর চিফ কমান্ডেন্ট গৌরীশঙ্কর রায় বলেন, “বিকাল ৪টে থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পুজোয় জনতার ঢল সামালাচ্ছেন ‘ট্রাফিক ওয়ার্ডেন’রা।” সর্বজনীন উৎসবে তাঁরা নিজেদের পরিবার পরিজনের সঙ্গ ছেড়ে ব্যক্তির দেওয়াল টপকে সর্বজনীন হয়ে ওঠেন। ওঁদের রাত ভর স্বেচ্ছাশ্রম ছাড়া পুজোর বহরমপুর শহরের কথা ভাবাই যায় না। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার ভরতলাল মিনা বলেন, “এই যুবকেরা পুরোপুরি স্বেচ্ছাশ্রমই দেন। তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করেন পুজোর উদ্যোক্তারা।”
বেশ কয়েক বছর আগে কিশোর আশুতোষ স্কুল ছাত্র থাকার সময় বন্ধুদের নিয়ে স্কুল-ছুট দুঃস্থদের জন্য অবৈতনিক স্কুল খোলে। বেলডাঙা থানার প্রত্যন্ত এলাকার গোপীনাথপুর গ্রামের ‘সূর্যোদয় বিদ্যাপীঠ’ নামের ওই স্কুলের পড়ুয়াদের প্রায় সবাই ক্ষেতমজুর, রিকশাচালক ও পরিচারিকা পরিবারের সন্তান। ফলে তাদের মধ্যে প্রায় ২০ জনের এ বারের ঈদ-পুজোয় নতুন পোশাক জোটেনি। ‘সূর্যোদয় বিদ্যাপীঠ’-এর প্রধানশিক্ষক আশুতোষ এখন বি এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাবা চৈতন্য ঘোষ ছেলেকে পুজোর পোশাক কেনার জন্য টাকা দিলেও আশুতোষ নিজের জন্য পোশাক কেনেনি। ফলে বিপদ গোনেন বাবা। চৈতন্যবাবু বলেন, ‘‘অবশেষে নিজেই বের হলাম। সব কথা শুনে বেলডাঙার জাহিদুর শেখ, সারিফুল শেখ-সহ কয়েক জন্য অর্থ সাহায্য করেন। ওই অর্থ দিয়ে ২০ জন দুঃস্থ খুদে পড়ুয়াকে নতুন পোশাক দেওয়া হল। ছেলের মনও শান্ত হল।”
পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের রাবণ মুর্মু বা বহরমপুর লাগোয়া নবগ্রাম থানার বিছন কিস্কুর রং বাহারি নতুন পোশাক কিন্তু নিজেদের মজুর খাটার টাকাতেই কেনা। আসলে উৎসবের বাজারে এখন অপরকে টেক্কা দেওয়ার ব্যাপারে এতটাই কম্পিটিশন যে রঙচঙে পোশাক না কিনে আদিবাসী ডাসাই শিল্পীদের গত্যন্তরও নেই। মাথায় রঙিন পাগড়ি দিয়ে বাঁধা ময়ূরের পালক দুলছে নাচের তালে, কোমরে ঝুলছে বাদ্যযন্ত্র, হাতে রয়েছে নৃত্যের তালে তালে খট্ খট্ আওয়াজ তোলা কাঠের যন্ত্র। ওই শিল্পীদের ঝঁকের পর ঝাঁক লাগোয়া ঝাড়খণ্ড ও নবগ্রাম থেকে পৌঁছে গিয়েছে বহরমপুরে। কয়েক দিন ধরে আপন খেয়ালে শহরের রাজপথ জুড়ে সাঁওতালি নৃত্যের ছন্দের যে মাদকতা বিলিয়ে চলেছেন তা তুলনা রহিত। কিন্তু কেন? রাবণ মুর্মুর সাফ কথা, “ওই কটা দিন বাঙালিবাবুদের মেজাজ থাকে দিল দরিয়া। তাই নাচ দেখিয়ে, গীত শুনিয়ে আমাদের রোজকার হয়।” কিন্তু কেবলই কি ইনকামের টান? নবগ্রামের বিছন কিস্কু শোনান দার্শনিক কথা। তিনি বলেন, “রঙের টানে বেরিয়ে পড়ি গো শহরের দিকে।” পুজোর সময় বিবিধের মাঝে ওই মিলন আজ এতটাই সহজাত ও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে যে ডাসাই শিল্পীদের বিষয়ে বাবুলবোনা পুজো কমিটির তপন সোম, নবারুন সমিতির অতীশ সিং, অনামী ক্লাবের সমু বাজপেয়ি থেকে প্রায় সবার এক কথা। তাঁরা বলেন, “আদিবাসী ডাসাই শিল্পীরা না আসা পর্যন্ত শহরের পুজা এখন আর সত্যিই জমে না।” |