কিছু মানুষ ছিলেন, এখনও আছেন, যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের
বলে চলেন, এখনই অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা। সম্প্রতি বিদায় নিলেন
তেমন দুই সহনাগরিক। কিন্তু বিদায় আর বিসর্জন এক নয়।
রংগন চক্রবর্তী |
রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার ১৫০ বছরের সমারোহের মধ্যে, মাস দুয়েক হল, নিঃশব্দে চলে গেছেন শান্তিনিকেতনের দু’জন মানুষ। এক জন শ্যামলী খাস্তগীর, আর এক জন বিকাশ চক্রবর্তী। শ্যামলীদি যদিও বা খানিকটা পরিচিত মুখ ছিলেন, শান্তিনিকেতনের নানান দিকে প্রায় দেখা যেত শ্যামলীদিকে, তাঁর বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্যে খোলা, বিকাশবাবু ছিলেন একেবারেই অন্তরালের লোক। ছাত্রছাত্রীরা চিনত তাঁকে দারুণ মাস্টারমশাই বলে। তাঁর কাজের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরাও শ্রদ্ধা করতেন তাঁর কাজ। আমি কাছ থেকে চিনতাম না এঁদের কাউকেই। দু’এক বার কথা হয়েছে মাত্র। কিন্তু শান্তিনিকেতনের বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতাম এঁদের গল্প। শ্যামলীদির ওপর স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পড়েছি ‘ধ্রুবপদ’ পত্রিকায়। কিন্তু এঁদের মৃত্যুসংবাদ শুনে কী রকম একটা সেন্স অব লস হল। ভাবার চেষ্টা করলাম কেন? ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’-এ রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা পড়ার গল্প আছে। কবিতাটা সম্ভবত ছিল: কুজ্ঝটি জাল যেই সরে গেল মংপুর, দূর শৈলের বুকে দেখা দিল রংপুর। তার পর রবীন্দ্রনাথ থেমে বলেছিলেন, এ কিন্তু তোমাদের (কোনও একটা রেলওয়ের) রংপুর নয়, বলে দিতে হবে না তো বোকাদের? আমাদের অনেক বাঙালির কাছে শান্তিনিকেতন ওই রকমই একটা রংপুর। রবি ঠাকুরের বিশাল আলোর উৎসের রং মাখা। সেটা ঠিক একটা জায়গা নয়, একটা ধারণা। যে যেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের নানান ছোটখাটো জীবনের যে যাত্রা তারই মধ্যে এক দারুচিনি দ্বীপের মতো জেগে থাকে সেই শান্তিনিকেতন। আমাদের অধিকাংশ মানুষই তাকে চিনি কারও না কারও লেখা দিয়ে, কারও না কারও মুখে গল্প শুনে। ছোটবেলায় গোগ্রাসে গিলেছি কত বই। সেই যে বুদ্ধদেব বসুর সব পেয়েছির দেশে। প্রমথনাথ বিশী, সুধীরঞ্জন দাশ, সৈয়দ মুজতবা আলির লেখা, আবার পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ আর রাণী চন্দ। জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতন, হ চ হ আর দিনুবাবু মিলে মিশে একাকার। বর্ষাকালে আশ্রমে সেই শুধু কচুর ঝোল, মুঙ্গেরের ভোলা আর তার পরেই শমীর মৃত্যু, আবার বেসুরো অধ্যাপককে শায়েস্তা করতে রাতের বেলায় করিডরে বেরিয়ে কার যেন সেই গান: ক’দিন প্রতি রাতে তোমার অত্যাচার, নগেন আইচ শত্রু হে আমার। পড়তাম আর ভাবতাম, একটা জায়গা আছে, যেখানে জীবনটা আরও বেশি রকম হওয়া উচিত সেই রকম।
ট্রেন বা গাড়ি চড়ে যে শান্তিনিকেতনে যাওয়া যায়, সেখানে গিয়েছি আমি বহু বার। কয়েক বছর আগে একটা আস্তানাও বানিয়েছি সেখানে। মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে সেই রংপুরের খোঁজে ছুটে যাওয়ার জন্যে। আমার বাড়িতে একটা ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবির অ্যালবাম ছিল। সাদা কালো ছবিগুলো পুরনো হয়ে কী রকম লালচে হয়ে যায়, ছবির টোনাল সাদাগুলো উবে গিয়ে কাগজের সাদার সঙ্গে মিলে মিশে যায়, সেই রকম। তাতে একটা ছবি ছিল, বাবা গরুর গাড়ি করে কোপাই পার হচ্ছেন, মাথায় টোকা। বোধ হয় ১৯৬০-৬১ সালের ছবি। আমি জানি আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম। একটু একটু মনে ছিল খোয়াই, উঁচু ঘাসের বন। কিনেছিলাম ছড়ি আর ফিরে এসে তার লোহা বাঁধানো মাথা ফেটে গিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়েছিল কয়লার গুঁড়োর মতো কী একটা। উদয়নে নাকি এসেছিলেন জওহরলাল নেহরু, আমরা বাইরে থেকে দেখেছিলাম, ওই দেখ পুনশ্চ, ওই দেখ শ্যামলী। যে লজে উঠেছিলাম, জানালা ছিল ছোট, খুব গরম ছিল, আর ছিল ডিমের ঝোল।
দল বেঁধে বেরোনোর বয়স হতেই আবার ফিরে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে পৌষমেলায়। বিজয়গড়ের পাঁচ-ছ’জন ছেলে। বাবু, চঞ্চল, কানু, হুনু বাবু, সুব্রত, রংগন, এই সব আমাদের নাম। ১৯৭২-৭৩ হবে। সিংহ সদনে খড়ের বিছানা ভাড়া, মাঠের পাশে ক্যান্টিনে দুপুরে ভাত ডাল লাবড়া। দেখলে হয়তো বোঝা যেত না যে, আমাদের কয়েক জন তাতে খুঁজছি আশ্রমের সেই কচুর ঝোলের স্বাদ। হয়তো বোঝা যেত না, যে আমার বন্ধু চঞ্চল জানত দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া প্রায় সব গান। বোঝা যেত না যে আমরা অনায়াসে রাত কাটিয়ে দিতে পারি পুরানো জানিয়ে চেয়ো না আমারে থেকে মোর ডানা নাই আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যায় পাসরি এই সব গান গেয়ে। পাশাপাশি সাতই পৌষের সকালে সেই চুলে ফুল গোঁজা মেয়েদের গল্পও ছিল। দেখে আমাদের এক জন বলেছিল, এই মাইয়াগুলান খালি পায়ে হাঁটতাসে, অগো তো হুক ওয়ার্ম হইব। বাঙালের স্বাস্থ্যচেতনার গল্প আজ থাক।
আমাদের সবার তো ডানা নেই। থাকার কথাও নয়। আমরা তাই নিজেদের খাঁচার ভেতর বাঁচায় আটকে থেকে অন্য কারও জীবন যাপনের গল্পে একটা উত্তরণের আদর্শ খুঁজি। রবীন্দ্রনাথের জন্যেই শান্তিনিকেতনকে সেই বাঁশরী বাজিয়ে চলার দায় নিতে হয়। এই গল্পটা জটিল। কারণ, সাধারণত আমরা ব্যক্তির মহত্ত্বকে মাপার চেষ্টা করি বস্তুগত পরিবেশে সদর্থক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা দিয়ে। সেই অর্থে দেখতে গেলে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাফল্যও সীমিত। এ কথা বোধহয় অস্বীকার করা যায় না, যে রবীন্দ্রনাথ যেমন ভাবে লক্ষ কোটি মানুষের বোধের বিকাশে পথ দেখিয়েছেন, সামাজিক বিকাশে পারেননি। সে দায় তাঁর নয়, আমাদের। আমরা তাঁকে অনেক ধারণায় আপন করলেও সমাজ বদলে যে বড় ভাবনার পথ হাঁটা দরকার, সে পথ ধরতে পারিনি। ইতিহাসের আধুনিকতা, ধনতন্ত্র, বাজার, রাজনৈতিক পার্টি ইত্যাদি জটিল সংগঠন, পরিবার, রাষ্ট্র, ধর্ম, মিডিয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান আমাদের নানান ফাটলে শিকড় গেড়েছে।
শান্তিনিকেতনে কিছু মানুষ ছিলেন, এখনও আছেন, যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের বলে চলেন, এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা। শ্যামলীদি আর বিকাশবাবু ছিলেন তেমনই দু’জন মানুষ। দু’জনের জীবন আলাদা ছিল। কাজের ক্ষেত্রও। বিকাশবাবু ইংরেজি পড়াতেন, অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর কাজে জোর ছিল রবীন্দ্রনাথকে দেখার একটা ঐতিহাসিক চোখ তৈরি করার ওপরে। ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট আর মানববোধের ইতিহাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ অধ্যয়নে। সহজ জীবনের সঙ্গে বিশ্বস্তরের জ্ঞানাভ্যাসের চর্চা চালিয়ে যাওয়ার যে ট্র্যাডিশন এক সময়ে শান্তিনিকেতনকে চিহ্নিত করেছিল, তিনি ছিলেন তাঁরই পতাকাবাহী। চলে গেলেন।
শ্যামলী খাস্তগীর ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী সুধীর খাস্তগীরের মেয়ে। শ্যামলীদির জীবনের গল্প সত্যিই আশ্চর্য। তবে তাঁর দু’টি উৎসাহের কথা আমরা জানতাম, দেখেওছি কিছুটা। তিনি ছিলেন সব রকমের যুদ্ধাস্ত্রবিরোধী আর প্রকৃতিপ্রেমী। কিন্তু এই দুই বোধকে কেবল আত্মিক স্তরে বিকাশ করিয়ে ক্ষান্ত দেননি তিনি। কানাডায় জেল যাওয়ার থেকে শুরু করে পৌষমেলায় প্লাস্টিক হঠানোর আন্দোলনে সবার সামনে এগিয়ে আসতেন শ্যামলীদি। বাঁচাটাই যে আপন রাজনীতির ধারণার পরিচয় হতে পারে, শ্যামলীদিকে চিনলে সেটা জানা যেত। পরিচিত জনেরা তাঁর তুলসীপাতার চা, ছাতুর কাবাব আর জবা ফুলের সালাডের গল্প বলেন। রিকশয় বসা শ্যামলীদি ছিলেন বিনোদবিহারীর আঁকা ছবির মতোই শান্তিনিকেতনের একটা মায়াময় রূপ। তাঁকে ঘিরে থাকত অনেক নতুন ছেলেমেয়ে। জীবনের নানা সংঘাত, বিশ্বাসের সংকট তাঁদের টেনে আনত এই জীবন-শিক্ষিকার কাছে। অনেকেই বলেন, শ্যামলীদি রোজকার জীবনের সঙ্গে বেঁচে থাকার বৃহত্তর গল্পটার একটা যোগ ঘটাতে শেখাতেন, বক্তৃতা দিয়ে নয়, নিজের জীবনটা বেঁচে। আপনি আচরি ধর্মের এত বড় বিজ্ঞাপন মিডিয়ায় নেই।
আমাদের চেনা রাজনীতির এক বিশাল সংকট হল মুখে বলা কথা আর জীবন যাপনের মধ্যে এক দুরপনেয় দূরত্ব। ক্রমশ আমরা আরও আরও বেশি করে দেখছি কী করে আমাদের মাটির নীচ থেকে উঠে আসছে রাজনীতির কঙ্কাল। শাসন প্রশাসন রেভলিউশন সবার কাবার্ডেই আসলে স্কেলিটন লুকিয়ে রাখতে হয়। চার পাশে শুনি লোকপাল নিয়ে বিতর্ক। বলতে লজ্জা করে, কোনও বিশ্বাস জাগে না। অণ্ণা হজারের ব্যক্তিগত উদ্যমের প্রতি অবমাননা না দেখিয়েও দেখি যাঁরা এই আন্দোলন নিয়ে লাফাচ্ছেন, সেই সব রাজনৈতিক রাজাদের আসলে কোনও নৈতিক আবরণ নেই, বড় উলঙ্গ তাঁরা সবাই। কাগজে পড়ি, তথ্যের অধিকার আইন মেনে চিঠি লিখে নিহত হচ্ছেন একের পর এক মানুষ। পঞ্চায়েত আমরা চিনি। লোকাল কমিটি আমরা দেখেছি। গ্রামসভাকে কী ভাবে প্রহসনে পরিণত করা যায় আমরা তার সাক্ষী। কী হবে এই লোকপাল দিয়ে?
সব দেখি আর ভাবি শ্যামলীদি, বিকাশদার মতো মানুষরা বোধহয় ছিলেন রবীন্দ্রবাদী। হয়তো এই বাদ সেই ভাবে বড় আন্দোলনে দেখা যায় না। কারণ, বড় আন্দোলন হলেই নানান ক্ষমতার গল্প ঢোকে। অনশনের প্যান্ডেলের চিরকালই টাকা লেগেছে। ছোটবেলায় বামপন্থীরা বলতেন টাটা বিড়লা তেরো নাম। পরে ওই দুই নামই আবার প্রতিষ্ঠিত বামেদের গানে ‘তেরো বাম’ হয়ে যান। হয়তো এই গুলিয়ে যাওয়া দিনে দু’জন ভাল লোক চলে গেলেন বলে আবার এক বার মনে হল, সব মরণ নয় সমান। |