ঘন জনবসতি, শহরের ব্যস্ততম অঞ্চলগুলির অন্যতম। তাহারই ভিতর একটি বাড়ি সাক্ষাৎ জতুগৃহ হইয়া বিদ্যমান ছিল। সমস্যা ইহাই যে, আগুন না লাগিলে জতুগৃহের প্রকৃত পরিচয় বাহির হয় না। অগ্নিকাণ্ডের পরেই তাহার স্বরূপটি প্রকাশিত হয়। শ্যামবাজার এলাকার সেই ভবনটিতে অবশ্য শুধু আগুন লাগিল এমন নহে, বিস্ফোরণও হইল। সেই বিস্ফোরণের সহিত বাহির হইল প্রকৃত ঘটনা। একটি বেআইনি বাজি কারখানা দিব্য জনবসতির ভিতর লুকাইয়া ছিল। উপরতলগুলিতে গৃহস্থের আবাসিক ভবন, নিম্নে বাজির কারখানা বিস্ফোরকে ঠাসা। কী ভাবে ইহা সম্ভব হইল, তেমন একটি বিস্ময় সঙ্গত। যাঁহাদের জানিবার কথা, তাঁহারাও জানিতেন না, এমন একটি দাবি শুনা গিয়াছে। দীর্ঘকাল ধরিয়া একটি বাজি কারখানা চালু থাকিবার পরেও যদি প্রশাসন এবং পুলিশের নিকট কোনও তথ্য না থাকে, তাহা দুঃখজনক। কার্যত, চূড়ান্ত প্রশাসনিক ব্যর্থতার শামিল। পূর্বে কিছুই জানিতাম না, বিস্ফোরণ ঘটিবার পরে টের পাইতেছি যে কারখানাটি ছিল এমন অসার একটি সাফাই গাহিয়া প্রশাসন দায় এড়াইতে পারে না। প্রথমত, জনবসতির ভিতর এমন কোনও কারখানা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া বিদ্যমান কি না, সেই খবরটি রাখা প্রশাসনের কর্তব্যের ভিতরেই পড়ে। খবরটি না থাকিলে বুঝিতে হইবে, কর্তব্যে গাফিলতি ঘটিয়াছে।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় কাউন্সিলর মহোদয় বলিয়াছেন, তিনি মাত্র বৎসরকাল হইল কর্তব্যভার গ্রহণ করিয়াছেন, সুতরাং এলাকার কোথায় কী চলিতেছে, তাহা খতাইয়া দেখিবার সময় পান নাই। তাঁহার কর্তব্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখিয়াও বলা চলে, ইহা সময়কালের প্রশ্ন নহে, ইহা একটি মানসিকতার প্রশ্ন। সেই মানসিকতাটি যথাযথ থাকিলে একটি ওয়ার্ড-এর ভিতর কোথায় কী ঘটিতেছে, তাহা বাহির করা বিশেষ কঠিন কর্ম নহে। এক বৎসরের ভিতর সম্ভব নয়, এমনও নহে। বিশেষত, বাজির কারখানার ন্যায় একটি বস্তু শতচেষ্টাতেও ছদ্মবেশে থাকিতে পারে না। যদি থাকে, তখন বুঝিতে হইবে, গভীরে কোনও সংকট আছে। সেই সংকটটি কী, অতঃপর তার অনুসন্ধান চলিবে নিশ্চিত। সেই অনুসন্ধানের ফল যদি এই একটি মাত্র ঘটনার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহা আদপেই সঙ্গত হইবে না। বরং, এই ঘটনা হইতে শিক্ষাগ্রহণ করিয়া যদি কলিকাতা শহর এবং রাজ্যের অন্য ঘনবসতি এলাকাতেও এই ধরনের বেআইনি কারখানার মূলোচ্ছেদ করা শুরু হয়, তাহাই হইবে এই মর্মান্তিক কাণ্ডের প্রকৃত প্রতিক্রিয়া।
দায়িত্ব জনসমাজেরও। কোথায়ও এই ধরনের কোনও আইনবহির্ভূত কাজকর্মের সন্ধান পাইলে তাহার প্রতিবাদ করিবার দায়িত্ব। প্রয়োজনে, তাহা প্রশাসনের গোচরে আনিবার দায়িত্ব। অন্য কাহারও নহে, নিজেদেরই সুবিধার্থে এই দায়িত্ব পালন। নাগরিক সমাজ কিন্তু এই বিষয়ে নিতান্তই নিষ্ক্রিয়। কোনও দুর্ঘটনা ঘটিবার পরে বিলাপে, আক্ষেপে এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে নিষ্ক্রিয় করিবার কার্যে তাঁহারা যে পরিমাণ উদ্যম এবং সময় ব্যয় করিয়া থাকেন, তাহার ভগ্নাংশও সময় মতো ব্যয় করিলে এই ধরনের দুর্ঘটনা রুখিবার একটি সদর্থক পথ বাহির হইতে পারিত। দুর্ঘটনা ঘটিলে প্রশাসনকে বিপুল গালি দিব, অন্য সময় সব জানিয়া-শুনিয়াও চুপ করিয়া বসিয়া থাকিব, ইহা কোনও ইতিবাচক মানসিকতার ছবি হইতে পারে না। অথচ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইহাই ঘটিতেছে। প্রশাসন এবং জনসমাজ উভয়ের তরফেই মানসিকতার পরিবর্তন না-ঘটিলে, শঙ্কা জাগে, নগর-এলাকায় অন্য কোনও বাড়ি ফের বিস্ফোরণে জ্বলিয়া উঠিবে। অতঃপর, বিলাপ, তদন্ত এবং পুনরায় নিষ্ক্রিয় দশা। গড্ডলপ্রবাহটি চলিতেই থাকিবে। |