জটিল সমস্যার সমাধান সহজে করিতে চাহিলে তাহার ফল ভাল না-হইবার সম্ভাবনাই অধিক। তরিতরকারির মূল্যে অতিবৃদ্ধি রাজ্যবাসীর নিকট একটি বড় সমস্যা, সন্দেহ নাই। কিন্তু সমাধানের যে উপায়টি রাজ্য সরকার স্থির করিয়াছে, তাহাতে সমস্যার নিরসন হইবে না। সরকারের প্রস্তাব এই যে, ‘কৃষি সমবায় নিগম’ তৈরি করিয়া সরকারের উদ্যোগে কম দামে সবজি কিনিয়া, কিংবা কৃষককে সরাস রি নিগমের দোকানে সবজি বিক্রি করিবার সুযোগ দিয়া, মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এবং দৌরাত্ম্য কমানো যাইবে। ফলে কৃষক অধিক দাম পাইবেন, ক্রেতাও ন্যায্য মূল্যে সবজি কিনিবেন। মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা যে নানা অজুহাতে কৃত্রিম ভাবে সবজির দাম বাড়াইয়া দেন, মুখ্যমন্ত্রী তাহা বুঝিয়াও তাহাদের নিয়ন্ত্রণের কোনও পথ খুঁজিয়া পান নাই। তাই বিপণনের সরকারি ব্যবস্থা তৈরি করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন।
ইহা সমর্থনযোগ্য নহে। প্রথমত, বাজারে বিপণনের ব্যবস্থা নানা কারণে কার্যকর না হইতে পারে। কখনও উৎপাদন বা আমদানি কম হইলে, কখনও চাহিদা বাড়িলে বা রফতানি অধিক লাভজনক হইয়া উঠিলে, কখনও বা অসৎ ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রে দেশের বাজারগুলিতে নানা জিনিসের দাম বাড়িতে পারে, অথবা প্রয়োজনীয় জিনিস অমিল হইতে পারে। জনস্বার্থে তাহার নিয়ন্ত্রণ কিংবা যথাযথ জোগান সরকারের কর্তব্য। কিন্তু তাহার অর্থ এই নহে যে সরকার স্বয়ং বিপণন শুরু করিবে। বাজারের ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করাই সরকারের কাজ, তাহার বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করা তাহার কর্তব্য নহে। দ্বিতীয়ত, অতীতের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে যে এ রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে বিপণনে সাফল্য সামান্যই আসিয়াছে। গরিব কৃষক কিংবা হস্তশিল্পীর প্রতি ব্যবসায়ীরা নিষ্ঠুর, কিন্তু সরকারি কর্মীরাও সদয় নহেন। এই রাজ্যে রেশন ব্যবস্থার চাল সংগ্রহের ভার একটি সমবায় নিগমের উপরেই ন্যস্ত হইয়াছে। তাহাতে গরিব চাষির কিংবা ক্রেতার উপকার হইয়াছে, এমন নহে। দুর্নীতি এবং অকর্মণ্যতার পরিণামে রাজ্যের একটি বড় অংশের মানুষের নিকট খাদ্য নিরাপত্তা অধরা থাকিয়া গিয়াছে। এই পুরাতন ঔষধের উপর নূতন করিয়া ভরসা করিবার কারণ কী?
সবজির মূল্য হ্রাস করা যাইবে কী উপায়ে? সর্বভারতীয় স্তরের ‘এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি’ নামাঙ্কিত উপদেষ্টা সমিতির বক্তব্য, স্থানীয় উৎপাদকের স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করিবার যে আইন রহিয়াছে, তাহা ছোট চাষিদের স্বার্থের পরিপন্থী। তাহার ফলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা একযোগে চাষিদের উপর চাপ সৃষ্টি করিবার এবং ঠকাইবার সুযোগ পাইয়াছে। অতএব এই আইন বদলাইয়া সব রাজ্যগুলির মধ্যে সবজির বিপণন সম্পূর্ণ অবাধ করিয়া দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগে বৃহৎ সংস্থার দ্বারা নানা ব্র্যান্ড নামাঙ্কিত খুচরা বিপণনের আয়োজনও বস্তুত কৃষক ও ক্রেতাদের স্বার্থের সহায়ক, কারণ তাহার ফলে মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কমে। সংস্থাগুলি কৃষকদের উৎপাদন তাহাদের থেকে কিনিয়া সরাসরি হিমঘরে পাঠাইতে পারে, যাহার ফলে সবজির অপচয় কমে। বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ সবজি যথাযথ সংরক্ষণের ফলে নষ্ট হয়। ইহাও সবজির দাম বাড়িবার একটি কারণ। কিন্তু মধ্যস্থতাকারীর একটি শৃঙ্খলের দ্বারা বিপণনের যে প্রথাটি এত দিন ছিল, তাহার ফলে সবজির সংরক্ষণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার কোনও উন্নতির চাহিদা তৈরি হয় নাই, উন্নতি ঘটেও নাই। বড় ব্যবসায়ীরা পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণ করিতে পারিবে। কার্যকর আইন, তাহার সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং পরিকাঠামোর উন্নয়নই সরকারের কর্তব্য। এগুলি নিশ্চিত করিতে পারিলে কৃষক ও ক্রেতা, উভয়েই লাভবান হইবে। বাজারকে দিয়া কাজ করাইতে না পারিবার অক্ষমতা সরকারি হস্তক্ষেপের অজুহাত হইলে বাজারেরও ক্ষতি, সমাজেরও। |