কখনও মহিষমর্দিনী দুর্গার অসুর বধের পালা। কখনও আবার গণেশের নাচ। কখনও যদি লবণাসুর বধের আখ্যান, কখনও বা নরক রাজা বধ।
বর্ধমানের লাল্টু স্মৃতি সঙ্ঘের মণ্ডপে পঞ্চমী থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে ছৌ-নাচ। পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে হুড়া থানার পালগাঁ গ্রামের শিল্পীরা এখন ডেরা বেঁধেছেন এই মণ্ডপে। তুমুল শব্দে বাজছে সানাই, ঢোল, ধামসা, নাগরা, মাদল, বাঁশি আর ঝুমঝুমি। বাজাচ্ছেন দলের পাঁচ বাদ্যকার। তাঁদের বাড়ি কূলাবহাল গ্রামে।
শহরে ভিড়ের একটা বড় অংশ ক’দিন ছিল এই মণ্ডপমুখী। মানুষকে মুগ্ধ করেও নিজেদের ‘পারফরম্যান্সে’ কিন্তু আদৌ খুশি নন এই দলের শিল্পীরা।
নাচের ছন্দকে আরও মসৃণ, নাচের মুদ্রাকে আরও পরিশীলিত করে তুলতে প্রশিক্ষণ নিতে চাইছেন তাঁরা। তাঁরা চাইছেন রাজ্য সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দফতর এগিয়ে আসুক এই কাজে। জেলার যে সমস্ত গ্রামে ছৌ-নাচের কারিগরদের বাস, সেই সব গ্রামে তৈরি হোক একটি কেন্দ্র। সেখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবীণ ছৌ নৃত্য শিল্পীরা নবীনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক বাজনদারদেরও। তা হলে এক দিকে যেমন ছৌ-শিল্প উন্নত হবে, তেমনি বেশি করে মিলবে বিদেশে যাওয়ার বরাত। তাতে হয়তো শিল্পীরা দু’বেলা নিশ্চিন্তে দু’মুঠো খেতে পারবেন। |
দুঃখ করছিলেন দলের সেকেন্ড ম্যানেজার অমূল্য সিংহ সর্দার। বলেছেন, “আমাদের নাচে সেই ছন্দ কী করে আসবে? চড়িদা গ্রামের বাসিন্দা ছৌ-নাচের মহারাজ গম্ভীর সিংহ মূঢ়া প্রথম জীবনে ছিলেন রাখাল। তিনি বনে বনে ঘুরে দেখেছেন বাঘের দীপ্ত চেহারা, ভালুকের হাঁটাচলা, হনুমানের লাফ। নিজের নাচে সেই সব কিছুর অনুলিপি তিনি করতে পারতেন সহজেই। তাই তাঁর নাচের এত নামডাক ছিল। আমাদের বাঘ, ভালুক দেখতে তো যেতে হবে চিড়িয়াখানায়! বন্দি পশুপাখি দেখে কী করে বুঝব তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কী করে?”
দলের নাকাড়াবাদক দোলগোবিন্দ মালের কথায়, “আমাদের এই ছৌ নাচ তো একটা সম্পদ। শুধু আমাদেরই নয়, গোটা দেশের। কিন্তু কী করে আরও প্রাণবন্ত শব্দে নাকাড়া বাজানো যায়, তা তো জানি না। তাই আমাদের প্রশিক্ষণ দরকার। সেটা পেলে আমরা অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারি। ভিন রাজ্য তো বটেই বিদেশের দর্শকদের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করতে পারি।”
তাই পালগাঁ বা কূলাবহাল চাইছে, গড়ে উঠুক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যে শিল্পী, বাদ্যকার প্রবীণ হয়েছেন, তাঁদের তো কোনও ভাতা চালু হয়নি এখনও। ছৌ নাচের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠলে তাঁরাও বার্ধক্যে দিন চালানোর মতো অর্থ পাবেন। নবীনেরা পাবেন তাঁদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ। তবে পালগাঁ বা কূলাবহালের লিখিত আবেদন সত্ত্বেও এই প্রস্তাবে এখনও সাড়া মেলেনি। রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সহ অধিকর্তা অরবিন্দকুমার সরকার অবশ্য বলেছেন, “লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে রাজ্য সরকার বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রস্তাবও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। কেন ওই শিল্পীদের আবেদনে সাড়া মেলেনি, খোঁজ নেব।” |