|
|
|
|
|
রিকশা টেনেও রাবণ
হাসছেন, হু হা হা
অনিমেষ বৈশ্য • কলকাতা |
|
রাবণ রিকশা টানেন। কর্ণ শুয়ে ছেঁড়া মাদুরে। সীতা খুঁজছেন বিপিএল কার্ড। অতল গাড্ডায় মহাকাব্যের নায়ক-নায়িকারা।
লঙ্কার রাজা রাবণের পরনে মলিন লুঙি। লুঙির উপর ফতুয়া। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সরু গোঁফ। বয়স ৭৫। পরাক্রমী লঙ্কেশ্বরের সঙ্গে বিশেষ মিল নেই। তারকেশ্বরের গুড়িয়া গ্রামে তাঁর ছোট্ট ঘর। ওটাই তাঁর সোনার প্রাসাদ। প্রাসাদের সামনে দাঁড় করানো রাবণের পুষ্পকরথরিকশা।
দুলালচন্দ্র পোড়েল রামযাত্রা শিল্পী। কানে কম শোনেন। বেশ কম। রোজগারপাতি সামান্য। তবে মেজাজে থাকেন। সকালে রুটি আর ভেলি গুড় খেয়ে পথে বেরোন। তখন তিনি অ্যামেচার পালার মনিব খা। কর চাইতে এসেছেন বাংলার নবাবের কাছে। দিল্লি থেকে। দুলালবাবু বললেন, “মনিব খাঁ কথায় কথায় বলতেন, যদি না-পাই বাংলার কর, তা হলে দিল্লীশ্বর প্রেরণ করিবেন ৪০ হাজার সৈন্যদল। রক্তস্নাত হইবে বাংলার পথঘাট হু হু হা হা হা।” তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছিলেন দুলালবাবুর পুত্রবধূ। মনিব খাঁর রক্তপিপাসু অট্টহাসিতে পাখাটা ছিটকে গেল হাত থেকে। বললেন, “শ্বশুরমশাই এমনই। যতক্ষণ বাড়ি থাকেন, যাত্রার ডায়ালগ আওড়ান। আমরা কেঁপে কেঁপে উঠি। আমাদের ছেলেমেয়েরাও দাদুর মতো। থেকে থেকে হু হু হা হা।”
আপনার গলায় তো খুব জোর। এই বয়সেও।
কী বললেন?
বলছি গলায় তো খুব জোর।
অ গলা। তা গলাটাই তো সব ভালমানুষের পো। আমরা রামযাত্রা করি। গলা গেল তো সব গেল। ‘এক লক্ষ পুত্র মোর, সোয়া লক্ষ নাতি। আমি কি ডরাই কভু ভিখারি রাঘবে!’ এটা যদি আপনি মিনমিন করে বলেন, পালা জমবে? পঞ্চাশ বছর ধরে এই কম্মো করছি। কত লোককে হাসিয়েছি। কত লোক ভয় পেয়েছে। কেঁদেছেও বহু লোক। পালা করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তাকত লাগে।
তা ঠিক। তবে শুধু পালা করে সংসার চলত?
চলে না তো। একটা পালায় কত টাকা মেলে! পঞ্চাশ-ষাট বড়জোর। সে-ও কি রোজ হয়! আগে পুজোয় মহালয়া থেকে পালা হত। রামযাত্রা ছিল, অ্যামেচার পালা ছিল। গমগম করত পুজো মণ্ডপ। লোকজন হাতে হ্যারিকেন নিয়ে পালা দেখতে আসত। এখন তো পালা-টালা তেমন হয় না। লোকে টিভি দেখে, ভিডিওতে হিন্দি সিনেমা দেখে।
কোথায় কোথায় পালা করতেন?
কোথায় না করেছি। পুড়শুড়া, জাঙ্গিপাড়া, খানাকুল, চাকদহ। তবে তারকেশ্বরে বাবার মন্দিরের সামনে জমজমাট পালা হত। রাত ৯টায় শুরু। যতক্ষণ পালা চলবে, ততক্ষণ মন্দির খোলা। বাবা পালাগান শুনবেন। এখনও হয়। তবে সেই জৌলুস নেই।
এই যে আপনি কানে শোনেন না, পালায় অসুবিধা হয় না।
বাবার মন্দিরে পালা হত বললাম তো।
বলছি, আপনি যে কানে শোনেন না এতে...।
ও কানে শোনার কথা বলছেন। না, অসুবিধা আর কী। রাম-লক্ষ্মণের মুখ দেখে বুঝে যাই, কী বলতে চাইছে। আসলে ডায়ালগ তো লেখা থাকে না। সব শুনে শুনে মুখস্থ করা। মুখস্থ না-থাকলে নিজেই বানিয়ে দিই। এলেম লাগে খুব। একটা কৃত্তিবাসী রামায়ণ ছিল। আগাগোড়া পড়েছি। বইটা আর নেই। একদিন খুব বৃষ্টি হল। মাটির ঘর চুঁইয়ে জল ঢুকল ঘরে। আমার রামায়ণটাও ভিজে চুপসে গেল। একটা রামায়ণ হলে খুব ভাল হত। খুব। কে আর শুনবে আমাদের কথা? চেটো দিয়ে চোখের কোণা মোছেন লঙ্কেশ্বর রাবণ। তাঁর অট্টহাসিটাও আচমকা চুপসে যায়।
রাবণের মতো অত গলার জোর নেই সুতপুত্র কর্ণর। বাবার থানের কাছেই বাড়ি সুবল মোদকের। শুয়ে ছিলেন ছেঁড়া মাদুরে। দশাসই চেহারা। বয়স নব্বই পেরিয়েছে। কথা বলতে গেলে হাঁফিয়ে ওঠেন। রাবণের রোলও করেছেন। রাজা হরিশ্চন্দ্র পালায় তিনি ছিলেন চণ্ডাল। বললেন, “বাবাজীবনেরা হঠাৎ আমার কাছে। মড়া পোড়ানোর গল্প শুনতে নাকি! ১৫৪৭ বার শ্মশানে গেছি। রামযাত্রায় রাবণ করেছি, মহাভারতে কর্ণ। বর্ণময় জীবন আমার।”
এখনও করেন নাকি রামযাত্রা?
না, হাঁফ ওঠে। কী সব ডায়লগ ছিল! কর্ণ বলছে কুন্তীকে, “মাতঃ আমি জাহ্নবীর জল ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, কৌরবদের আমি কভু না ত্যাজিব! তবে অর্জুনকেও আমি কোনওদিন বধ করিব না।” কুন্তী হাহাকার করত, পুত্র আমার, পুত্র আমার।
সুবলবাবুর আর্তনাদ শুনে দরজার সামনে দু-একজন লোক জমে যায়। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “দর্শক, দর্শকই হচ্ছে আসল কথা। আমার পালা যদি লোকে না-ই শুনল, তা হলে কীসের অভিনেতা আমি। সামিয়ানার নীচে দাপিয়ে বেড়াব, সামনে অগণিত মাথা। হাততালির পর হাততালি পড়বে। নেশা ধরে যায়। আর ছিল মালা ডাক। কখনও ফুলের মালা, কখনও বিস্কুটের মালা। পালার মালিক মালা ডাকত, দু টাকা, তিন টাকা, পাঁচ টাকা। গাঁয়ের মাতব্বর গোছের কেউ হয়তো একশো টাকায় কিনে নিত সেই মালা। আমরাও ভাগ পেতাম। অষ্টমীর রাতে মালার দাম উঠত চড়চড় করে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন সুবলবাবু। চোখের সামনে নাচতে থাকে সোনাঝরা দিন।
আর সীতা?
ধরণীর বুক চিরে কাটা হচ্ছে মাটি। সেই মাটি ঝুড়িতে করে তিনি ফেলছেন পথে-প্রান্তরে। সীতা মানে মমতা সরকার। চাঁপাডাঙার বৌ। সবে একশো দিনের মাটি ফেলে উঠেছেন। শ্রান্ত শরীর। বললেন, “আমি হলাম বনবাস থেকে সীতা। বনবাসের আগের সীতা করে আমার মেয়ে প্রতিমা।”
সে কী! দর্শক বুঝতে পারবে তো!
আমার যা বয়স, তাতে বনবাস থেকে শুরু হওয়াই ভাল। মলিন চেহারা। চোখের কোণে কালি। সারাদিন মাটি ফেলে শরীরে আর কিছু থাকে না। কোথায় মিথিলা কন্যা। আর কোথায় আমি।
সীতার ঘরে একটি বাঁধানো ছবি। তিনি সীতার নবদুর্বাদলশ্যাম। বছর কয়েক আগে গত হয়েছেন। ক্যান্সারে। মমতাদেবী বলেন, “আজ রামযাত্রা করি তো কাল লেটো যাত্রা। কালই করেছি ‘টাকার মাথায় বুড়োর বিয়ে।’ সরকার থেকে লেটো যাত্রা হয়। কিছু পয়সা পাই। বিধবা ভাতা তো পাইনি। দোরে দোরে কত ঘুরেছি। বিপিএল কার্ডও নেই।”
পুজোয় বায়না নেই?
কে বায়না করবে! লোকজনের ভক্তিশ্রদ্ধা আগের মতো নেই। রামযাত্রা কে আর শোনে! নেশা তো! তাই নিয়ম করে বাড়িতেই হাসি, কাঁদি, গান গাই। কেউ না শুনুক, উনি তো শোনেন। স্বামীর ছবিতে হাত ছোঁয়ান মমতা।
পথে-প্রান্তরে বাজছে অকালবোধনের আগমনী সুর। মাথার উপর শরতের নীল চাদর। আর রাবণ-সীতা-কর্ণ খুঁজছেন সেই সামিয়ানাটা। যার নীচে দাঁড়ালে হারিয়ে যায় সীতার মাটির ঝুড়ি, রাবণের রিকশার হর্ন। |
|
|
|
|
|