আপাতত অপেক্ষায় রাজ্য
অভিযান না হলে এক মাস অস্ত্র সংবরণ মাওবাদীদের
রাজ্য সরকার ও মাওবাদীদের মধ্যে টেনশন এবং রেষারেষি যে তুঙ্গ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা আপাতত ‘প্রশমিত’ করতে এক পা এগোল মাওবাদীরা।
একেবারেই কাকতালীয়। কিন্তু মঙ্গলবার, মহাষ্টমীর সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তাঁর বাড়ির কাছেই একটি ঘরোয়া পুজোয় সন্ধিপুজোর অঞ্জলি দিতে যাবেন, তার কয়েক ঘণ্টা আগে মাওবাদীদের তরফে জানানো হল, শর্তসাপেক্ষে তারা (জঙ্গলমহলে) এক মাসের জন্য অস্ত্র সংবরণ করছে।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁর নির্দেশক্রমে রাজ্য সরকারের তরফেও ওই বিষয়ে কোনও সরাসরি মন্তব্য করা হয়নি। মুখ্যসচিব সমর ঘোষ শুধু বলেছেন, “এখনও সরকারি ভাবে কিছু হাতে পাইনি। পেলে আলোচনা সাপেক্ষে সরকারের বক্তব্য জানাতে পারব।”
কার্যত একই বক্তব্য মুখ্যমন্ত্রীরও।
এ দিন বিকেলেই ‘বেসরকারি’ স্তরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মাওবাদী এবং তাদের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীদের তরফে ওই যৌথ বিবৃতির খবর পৌঁছোয়। কিন্তু মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রে বলা হয়, এখনই ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করার মতো ‘পরিস্থিতি’ তৈরি হয়নি। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “যতক্ষণ না আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর বা রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতরে প্রস্তাব পৌঁছোচ্ছে, ততক্ষণ সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মতো কারণ বা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।” বস্তুত, প্রশাসনের একাংশ উল্টে মনে করছে, এমনও হতে পারে যে, সাময়িক এই ‘সংঘর্ষবিরতি’ বা ‘অস্ত্র সংবরণের’ প্রস্তাবের ফাঁকে মাওবাদীরা আবার জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি গাড়ার ‘সুযোগ’ খুঁজবে।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, তিনি আগে দেখতে চান, মাওবাদীদের ‘কথায়-কাজে’ ফারাক রয়েছে কিনা। মাওবাদীদের তরফে ‘শর্ত’ চাপানো নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ ‘সন্তুষ্ট’ নন। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, “আগে দেখতে হবে, মাওবাদীরা যে প্রস্তাব দিয়েছে, তারা নিজেরা সেই অনুযায়ী চলে কিনা। তাদের সদিচ্ছা আছে কিনা। রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী একাধিক বার স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের প্যাকেজ থেকে শুরু করে জঙ্গলমহলের উন্নয়ন সমস্ত বিষয়েই তিনি তাঁর নীতি সরাসরি জানিয়েছেন। বল এখন ওদেরই কোর্টে।”
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘রাজ্য সরকার যদি এক মাস যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় ও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, তা হলে আমরাও এক মাস অস্ত্র সংবরণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার কথা দিচ্ছি’। মাওবাদীরা গত সপ্তাহেই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে যে ‘খোলা চিঠি’ পাঠিয়েছিল, তার তুলনায় এ বারের বিবৃতির সুর যথেষ্টই ‘নরম’। এই বিবৃতিতে মধ্যস্থতারীদের সই থাকাও যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। যে কারণে এই বিবৃতিকে জঙ্গলমহলে শান্তি প্রক্রিয়ার পক্ষে ‘ইতিবাচক’ ধরা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, মমতা আগামী ১৪ তারিখ, শুক্রবার ঝাড়গ্রামে একটি ‘রাজনৈতিক’ সভা করবেন। তার পরদিন, শনিবার নয়াগ্রাম এবং গোপীবল্লভপুরের মাঝামাঝি কোনও এলাকায় এক সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি জঙ্গলমহলের জন্য সরকারের বিভিন্ন ‘উন্নয়নমুলক’ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। তিনি রাজনীতি এবং উন্নয়নের অস্ত্রে তাদের মোকাবিলা করতে চান। ঝাড়গ্রামের সভা থেকে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যেমন মমতা চান ‘রাজনৈতিক সঙ্কেত’ দিতে (কারণ, ওই সভা হবে মাওবাদীদের হাতে অতি সম্প্রতি জঙ্গলমহলে নিহতদের খুনের ঘটনার প্রতিবাদে) তেমনই পরদিনের সরকারি কর্মসূচিতে চান মাওবাদী তথা জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে ‘উন্নয়নের বার্তা’ দিতে। জঙ্গলমহল-সফরেই মমতা পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা অধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকও করবেন।
ঝাড়গ্রামের সভায় যাতে প্রচুর জনসমাগম হয়, তার জন্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় এবং দলের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। এর আগে ঠিক ছিল, ১৫ তারিখ দিল্লিতে একটি বৈঠকে যোগ দিতে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। আপাতত তা পিছিয়ে ২২ তারিখ হয়েছে। তা জেনে সোমবার রাতেই পরপর দুই নেতার সঙ্গে ফোনে কথা হয় মমতার। গত দু’সপ্তাহে মমতা মুকুলবাবুকে জঙ্গলমহলে একাধিক পদযাত্রা ও সভা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসব সভা ও পদযাত্রা ‘সফল’ হয়েছে বলেই খবর পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার প্রেক্ষিতেই তাঁর জঙ্গলমহলে পরপর দু’দিন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মসূচির সিদ্ধান্ত। মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, দু’টি সভা থেকেই মাওবাদীদের উদ্দেশে ‘জরুরি বার্তা’ দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, এ-ও জানাতে চান যে, সরকার কিন্তু অনন্তকাল ধৈর্য ধরে থাকবে না। যে কথাটা মাওবাদীদের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীদের বৈঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মমতা।
মাওবাদীদের সঙ্গে সুজাত ভদ্রদের মতো মানবাধিকার কর্মীদের ‘মধ্যস্থতা’ যে একটি ‘ইতিবাচক’ জায়গায় পৌঁছেছে, তা গত শুক্রবারই জেনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার অব্যবহিত আগেই বৃহস্পতিবার সুজাতবাবুদের সঙ্গে আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকার মাওবাদীদের বিষয়ে যথেষ্ট ‘কড়া’ মনোভাব দেখিয়েছিল। এমনকী, সুজাতবাবুরা চেয়েছিলেন, ঝাড়খন্ডের জেলে বন্দি মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলতে। সে বিষয়ে তাঁরা মমতাকে ঝাড়খন্ড সরকারের সঙ্গে কথা বলার আবেদন জানালে মমতা তা-ও খারিজ করে দেন। আলোচনার সময় মুখ্যমন্ত্রী সরাসরিই মাওবাদীদের একাধিক বার ‘জঙ্গল মাফিয়া’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল খুব স্পষ্ট আগে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের ‘খুনের রাজনীতি’ বন্ধ করতে হবে! না হলে রাজ্য সরকার বাধ্য হবে কড়া পদক্ষেপ করতে। তার পরদিনই সুজাতবাবুরা জঙ্গলমহলে আলোচনায় যান। সেখান থেকে ফেরার সময়েই তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, বিষয়টি ‘ইতিবাচক’ পথে এগোচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এ দিনের বিবৃতিটি তৈরি হয়েছিল শুক্রবারই। সেটি প্রকাশ করা হল এ দিন। দু’টি বিবৃতিই দেওয়া হয়েছে সাদা কাগজে। মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যৌথ বিবৃতির সঙ্গেই পৃথক ভাবে আকাশের নামেও একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই বিবৃতিও সাদা কাগজে। সিপিআই (মাওবাদী)-র দলীয় প্যাডে নয়। সে জন্যও প্রশাসনের একাংশ বিবৃতির ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিয়ে ইষৎ ‘সন্দিহান’। রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “এই বিবৃতি যে মাওবাদী নেতার, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। আমরা সেই বিষয়টি নিয়ে আগে নিঃসন্দেহ হতে চাই।”
প্রসঙ্গত, বিবৃতি তৈরির সময়েই ঠিক হয়েছিল যে, বিষয়টি আরও কিছুদিন পর ‘জনসমক্ষে’ আনা হবে। সেইমতোই এদিন মাওবাদী নেতা আকাশ, সুজাতবাবু এবং ছোটন দাসের তরফে সাংবাদমাধ্যমের কাছে যৌথ বিবৃতি পাঠানো হয়।
মাওবাদী নেতা আকাশ বিবৃতিতে দাবি করেছেন, ৩ অক্টোবর থেকেই যৌথ বাহিনীর শিবির সীমিত রাখতে হবে এবং গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ মাওবাদীদের দেওয়া ‘সময়সীমা’ সোমবার থেকেই শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে মধ্যস্থতাকারীদের আলোচনার কথা জানিয়ে আকাশের একক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এক মাস যৌথ বাহিনীর টহলদারি বন্ধ থাকলে মাওবাদীরাও অস্ত্র ব্যবহার করে বা ‘জনরায়’ অনুসারে কাউকে ‘শাস্তি’ দেওয়া বন্ধ রাখবে। আলোচনা প্রক্রিয়ার জন্য তাদের তরফে একটি তদারকি দল গড়া হবে বলেও জানিয়েছে মাওবাদীরা। কিন্তু আলোচনার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য ‘ভৈরব বাহিনী’, ‘জনজাগরণ মঞ্চ’, ‘হার্মাদ’, ‘গণ-প্রতিরোধ কমিটি’-সহ সব ধনের মঞ্চকে সরকারের তরফে অস্ত্রমুক্ত করতে হবে। এক মাসের ‘পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ করে তারা আবার পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর অভিযান আপাতত বন্ধ। মাওবাদীদের ‘সক্রিয়তা’ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা আবার শুরু করার কথা বিবেচনা হচ্ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে খোলা চিঠিতে মাওবাদীদের অভিযোগ ছিল, অগস্ট থেকেই জঙ্গলমহলে বাহিনীর অভিযান তীব্র হয়েছে। সেই সূত্রেই এ দিনের বিবৃতিতে বাহিনীর অভিযান বন্ধ রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আরও শর্ত, ‘বিভিন্ন সশস্ত্র মঞ্চ-সহ হার্মাদ বাহিনীকে অস্ত্রমুক্ত করার জন্য উদ্যোগী সরকারকেই হতে হবে। এই ধরনের সশস্ত্র আক্রমণের চেষ্টা বা ঘটনা আমরা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সরকারকে জানাব, যাতে সরকার তৎপর হয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়। এই শর্তপূরণের মাধ্যমে আলোচনার পরিবেশ গড়ে উঠবে বলে আমরা মনে করছি’।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.