আমার জন্ম ১৯২৫ সালে। তখন বিষ্ণুপুরের বাতাসে লোককথা ভেসে বেড়াত। মদমমোহনের কামানদাগা, বর্গী বিতাড়ন, লালবাঈ কিংবা সতী চন্দ্রপ্রভার কথা- শোনা যেত। দুর্গাপুজো যত এগিয়ে আসত, মল্লরাজধানী বিষ্ণুপুর তত মেতে উঠত। কেল্লা অঞ্চলে রাজবাড়ি। চারপাশে সুন্দর সুন্দর মন্দির। কেন্দ্রস্থলে মল্ল মহাদেবী মৃন্ময়ী। দেবী মৃন্ময়ীকে কেন্দ্র করেই তখন বিষ্ণুপুর পুজোয় বেশি মেতে থাকত। তিনিই বিষ্ণুপুরের অধিষ্ঠাতী।
রাজবাড়ির পুজোর বাইরে দ্বিতীয় জনপ্রিয় পুজো ছিল লালবাঁধের সামনে সর্বমঙ্গলা দেবীর পুজো। তারপরেই ছিল গোপালগঞ্জের কুর্চিবনের দশভূজা। আমাদের বাড়ির পাশে কবিরাজপাড়া সর্বজনীনের পুজো নিয়েই আমাদের বেশি মাতামাতি ছিল। মনে পড়ে, আমি ও আমার বন্ধু গুরুপ্রসাদ সরকার পুজোর দিন গুনতাম। স্কুল থেকে ফেরার পথে কবিরাজপাড়ায় প্রতিমা তৈরি করা দেখতাম। কী ভাবে শিল্পী সুচারু হাতে ধীরে ধীরে মায়ের রূপ ফুটিয়ে তুলতেন, অবাক বিস্ময়ে তা দেখতাম। পুজো শুরুর দিন থেকেই ঢাকিদের পিছু ছাড়তাম না আমরা। মিষ্টি বোলে তাঁরা কী ভাবে পুজো মণ্ডপ মাতিয়ে রাখছেন তা দেখতাম।
পুজো মানে ভরপেট খাওয়া দাওয়ার সুখ স্মৃতি আজও মনের মধ্যে গাঁথা। বাড়িতে মিষ্টি তৈরির জন্য ভিয়েন বসত। ময়রারা মিষ্টি তৈরি করতেন। খইচূর, টানা নাড়ু, দরবেশ-আরও কত রকমের মিষ্টি তৈরি করা হত। ছাতনার লক্ষ্মীশোলে আমার মামারবাড়ি। সেখান থেকেও মিষ্টি আসত। বিজয়ার দিন তো বটেই, পুজোর অন্যান্য দিনেও বাড়িতে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন যে আসতেন, তাঁকেই মিষ্টিমুখ করানো হত।
আমাদের থিয়েটার দেখার খুব টান ছিল। পুজো এলেই বসুপাড়া ড্রামাটিক ইউনিয়নের থিয়েটার দেখতাম। মল্লেশ্বর ভট্টাচার্য বাড়ির আঙিনাতেও নাটকের আসর বসত। হুগলি, মেদিনীপুরের পেশাদারি হলের নাটক ছিল দেখার মতো।
এখনও রাজবাড়ির পাশে মুর্চার পাহাড়ে ‘ক্ষণ’ ঘোষণার কামান গর্জালে মনে হয় ছুটে যাই। পুজো ঘিরে নানা স্মৃতি ঘুরে-ফিরে আসে।
|