এই পরিবারের পুজো যেন জাতপাতের সামাজিক ব্যধির বিরুদ্ধে এক জোরালো জেহাদ!
দুবরাজপুরের যশপুর গ্রামের সাহানা পরিবার গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার। সেটা কোনও গল্প নয়। বহু বছর ধরে বাগদি পরিবারদের দেওয়া ফুলেই এই পরিবারের পুজো হয়। গল্প এটাই। শুধু তাই নয়, প্রতিমা গড়ার মাটিও বাগদি পরিবারের সদস্যেরাই জোগাড় করেন। কী কারণে ও ঠিক কবে এই রীতির প্রচলন করেছিলেন বাড়ির পূর্বপুরুষেরা, সেটা না জানলেও দুর্গাপুজোর সময় এই নিয়মের কোনও ব্যত্যয় হয় না সাহানা পরিবারে। আজও নিষ্ঠাভরে আন্তরিকতার সঙ্গে সেই প্রথা মেনে আসছেন বাড়ির বর্তমান বংশধরেরা। |
যশপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে সাহানাদের দুর্গা মন্দির। পাকা দেওয়াল, টিনের চাল। এক সময় এখানেই মাটির দুর্গা মন্দির ছিল। এই দুর্গাপুজো কমপক্ষে তিনশো বছরের প্রাচীন বলে জানালেন পরিবারের প্রবীণ সদস্য রবিলাল সাহানা। পরিবার সূত্রে যেটুকু জানা গেল, তা হল, কুলগুরু দক্ষিণারঞ্জন চক্রবর্তীর নির্দেশে এই পরিবারে দুর্গাপুজোর সূচনা। আদতে চট্টোপাধ্যায় পরিবার হলেও হেতমপুর রাজাদের দেওয়া উপাধি ‘সাহানা’-ই ব্যবহার করেন এই বাড়ির সদস্যেরা। রথের দিন যশপুরের বাগদি পরিবারের সদস্যদের দেওয়া মাটির কাঠামো থেকে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। প্রতিমা তৈরি শেষ না হলেও চতুর্থীর দিন শশা বলি দিয়ে সাহানা বাড়িতে পুজোর সূচনা। আরও কতগুলি রীতি মেনে চলা হয় এই পুজোয়। যেমন এখানে যজ্ঞ হয় না, ঢাকের পরিবর্তে বাজে ঢোল।
দশমী পর্যন্ত বাগদি পরিবারের সদস্যদের দেওয়া ফুলেই চলে পুজো। সাহানা পরিবারের কেউ চাইলেই ফুল আনতে পারেন। কিন্তু রীতি মেনে বাগদিদের আনা ফুলই সবার আগে ব্যবহার করা হয় বলে জানালেন বাড়ির লোকজন। বর্তমানে সাহানা পরিবারটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত। পালা করে তাঁরা পুজোর খরচ চালান। কিন্তু পুজোর ক’টা দিন পরিবারের সব সদস্যই জড়ো হন যশপুরের আদি বাড়িতে। বাড়ির বধূ শিবানী সাহানা বা মেয়ে ঠান্ডা ভট্টাচার্যের কথায়, “কর্মসূত্রে বাড়ির সদস্যেরা যে যেখানেই থাকুন না কেন, পুজোর সময় সবাই সামিল এই বাড়িতে।” তাঁরাই জানালেন, এক সময় দুর্গা মন্দিরের চারদিকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত জমি ছিল সাহানা পরিবারের। সময়ের সঙ্গে সেই জমির অধিকাংশই আর নেই। কিন্তু পুজোর আন্তরিকতা ও রীতিতে তার কোনও আঁচ পড়তে দেওয়া হয়নি। তবে আগে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ত প্রসাদ খেতে। সেই সংখ্যাটা তুলনায় কমেছে। যাঁদের সঙ্গে এই পুজোর নিবিড় যোগ, যাঁদের ছাড়া এ পুজো হয় না, সেই বাগদি পরিবারের মীরা বাগদি, রিঙ্কু বাগদি, বুদ্ধদেব বাগদিরা বললেন, “কখন কী ভাবে আমাদের পরিবারের পূর্বপুরুষেরা সাহানাদের দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, আমাদের তা জানা নেই। তবে গ্রামের এই সবচেয়ে পুরনো পুজোয় আমাদের ভূমিকা থাকে ভাবলেই ভাল লাগে।” |