প্রবন্ধ ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
প্রথম বার প্রথম শোনা
গানের রোমাঞ্চ স্মৃতি
কটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে একতলা আর দোতলার সিঁড়ির মাঝখানে। দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক পরিবার, একতলায় দু’ঘর ভাড়াটে। উত্তর কলকাতায়। ওপর তলায় রেডিয়ো আছে। ট্রানজিস্টর রেডিয়ো আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত রেডিয়ো ছিল বেশ দামি জিনিস, আর্থিক সচ্ছলতার চিহ্নই ছিল বাড়িতে রেডিয়ো ও টেলিফোন থাকা। রেডিয়োর জন্য ছাদে টাঙানো থাকত এরিয়াল, অর্থাৎ দূর থেকেই বোঝা যেত, কোন বাড়িতে আছে রেডিয়ো। তখন রেডিয়ো ছিল দু’রকম, একটিতে স্থানীয় অনুষ্ঠান শোনা যেত, আর একটি অল ওয়েভ, সেটি বেশ সুদৃশ্য একটা যন্ত্র, দেখলেই বেশ ভক্তিশ্রদ্ধা হয়, তাতে দেশবিদেশের অনুষ্ঠান ধরা যায়।
ওপর তলায় রেডিয়ো বাজছে, ভাড়াটেদের ছেলেটির যখন তখন সেখানে যাবার অধিকার নেই, তাই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, সদ্য সন্ধেবেলায় গান শুনছে। শুনছে মানে কি, প্রবল তৃষ্ণার্তের মতন সে সেই সংগীতসুধা পান করছে। সেই বয়েসে, এক-একটি রবীন্দ্রসংগীত প্রথম বার শোনার যে অভিজ্ঞতা, তার যে রোমাঞ্চ, তা অন্য কেউ বুঝবে না। গান গাইছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক তরুণী, ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালবাসায় ভোলাব’। বিশেষত প্রেমের গানে তাঁর সমস্ত মর্ম যেন নিবেদিত হয়। রেডিয়োর মালিক পক্ষের কেউ গানটার মাঝখানে পট করে বন্ধ করে দিল। ছেলেটির মনে হল, তার বুকে যেন কেউ হঠাৎ গুলি করেছে। সে সত্যি সত্যি এক আহত কিশোরের মতন সেই প্রায়ান্ধকার সিঁড়িতে বসে রইল কিছুক্ষণ।
বলাই বাহুল্য, সেই কিশোরটিই আমি। গানটা মাঝপথে বন্ধ করে দিয়ে বাড়িওয়ালারা আসলে আমার বেশ উপকারই করেছিলেন। গানটা আমার বুকের মধ্যে সারা জীবনের মতো একেবারে গেঁথে যায়, পরের তিন-চার দিন আমি সব সময় গানটির প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি নিঃশব্দে গেয়েছি, আর ‘জানবে না কেউ কোন তুফানে’র পরের লাইনগুলি শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি।
কিংবদন্তি
সন্তোষকুমার ঘোষ দেবব্রত বিশ্বাস
তখন গান শোনার দু’টিই উপায়। রেডিয়ো অথবা গ্রামোফোন। রেকর্ড প্রথার কত বিবর্তন ঘটে গেল এর মধ্যে। আমাদের বাল্যকালে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে গ্রামোফোন ছিল এক আশ্চর্য বস্তু। তারা মনে করত, চোঙের মধ্য দিয়ে সত্যি সত্যি কেউ গান গায়। গ্রামে থাকার সময় শিশুকালে আমারও দু’এক বার এ রকম ধন্দ লেগেছিল। তখন রেকর্ড ছিল, আটাত্তর আর পি এম, তাতে এক পিঠে একখানা গান। তার পর পঁয়তাল্লিশ আর পি এম, তাতে গান দু’খানা। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এ সব রেকর্ডই শুনেছেন, তাঁর একটা গান আছে,
‘বান্ধবীকে গান শোনাতে ডাকতে হয় সতীশকে
হৃদয়খানা ঘুরে মরে গ্রামাফোনের ডিস্কে...’

আমাদের যৌবনকালেই বেরোল লং প্লেয়িং রেকর্ড, একসঙ্গে অনেক গান। তখন মনে হয়েছিল এ যেন উন্নতির পরাকাষ্ঠা। আমাদের বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল না, অন্য কোনও বাড়িতে ওই একখানা লং প্লেয়িং রেকর্ড হাতে নিলেই রোমাঞ্চ হত। এখন সেই সব রেকর্ড রাস্তায় ফেলে দিলেও নেওয়ার লোক নেই, কারণ বাজাবার যন্ত্র যদি বা কারও বাড়িতে থেকেও থাকে, কিন্তু পিন পাওয়া যায় না। কিছু দিন ওই রেকর্ড ভেঙে বাচ্চাদের খেলনা বানানো হয়েছে।
তার পর এল ক্যাসেট প্লেয়ার। তখনই গান শোনার সুযোগ এসে গেল আমজনতার কাছে। ওই যন্ত্র বা ক্যাসেটের দাম মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে। তখনই বাংলা গান অনেকের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। তার আগে রবীন্দ্রসংগীতের একটা সম্মানের জায়গা ছিল ঠিকই, উচ্চ বিদ্বজ্জন মহলে এ গান শোনা বা শেখার চল ছিল, কিন্তু মোটেই জনপ্রিয় ছিল না। বরং অনেকে বলত রবীন্দ্রসংগীত ন্যাকা-ন্যাকা গান, কোনও এক জন বিশিষ্ট গায়ক সম্পর্কে বলা হত, ওঁর গান শুনলেই ঘুম পেয়ে যায়, উনিও তো গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়েন!
ক্যাসেট প্লেয়ার প্রচলনের কিছু দিনের মধ্যেই এসে গেল একটা অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার, টু-ইন ওয়ান, অর্থাৎ একই যন্ত্রে ইচ্ছে মতন রেডিয়ো শোনা, অথবা ক্যাসেটে পছন্দ মতন গান। এই সময় আমার একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়। আমি আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে মেদিনীপুরের গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলাম। মেদিনীপুরের প্রায় কোনও বাড়িতেই বাথরুম বা টয়লেটের বালাই নেই, এমনকী মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারেও পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে ওই কর্মটি সারতে যায় মাঠে-ঘাটে বা নদীর ধারে। (আহা, এখন হয়তো অনেক বাড়িতে হয়েছে মেদিনীপুরেও, তখন ছিল না।)
মহিলারা যেতেন ভোর হওয়ার আগে বা সন্ধ্যায়, আর পুরুষরা যখন তখন ঝোপঝাড়ের আড়াল খুঁজে বসে পড়তেন, কাছাকাছি কোনও মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলে গলা খাঁকারি দিতেন। (শক্তি ও রকম গলা খাঁকারির আওয়াজ শুনে এক জনকে বলেছিল, কী, গলায় আটকে গেল নাকি?) কয়েকটি গ্রামে দেখেছি এ ব্যবস্থার পরিবর্তন। কোনও ব্যক্তি উক্ত প্রয়োজনীয় কাজটি সারতে মাঠে যাওয়ার সময় এক হাতে নিতেন জলভর্তি গাড়ু, অন্য হাতে একটি ক্যাসেট প্লেয়ার বা টু-ইন ওয়ান! ঝোপের আড়ালে গান বাজলেই বোঝা যাবে যে ও দিকে যাওয়া চলবে না।
এখন ও-সব ক্যাসেট প্লেয়ারটেয়ারও বাতিল হয়ে গেছে। এসে গেছে সি ডি কিংবা ডি ভি ডি-র যুগ। (এদের পুরো নাম যে কী, তা আমি জানি না। ইদানীং অ্যাব্রিভিয়েশনের উৎপাত খুব বেড়েছে, এ বি সি ডি; আই জে কে এল; কিংবা ডব্লু এক্স ওয়াই জেড বলতে যে কী বোঝায়, তা মানুষ জানবে কী করে?) টি ভি এসে রেডিয়ো’কে কোণঠাসা করে দিয়েছে, ডি ভি ডি খুবই সস্তা, অনেক জায়গায় কোনও কিছুর সঙ্গে বিনা পয়সাতেও পাওয়া যায়। গান শুনতে চাইলে এখন আর সুযোগের অভাব নেই।
ধান ভানতে শিবের গীতের মতন আমার প্রথম একটি রবীন্দ্রসংগীত শোনার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে একটা ছোটখাটো ইতিহাস চলে এল। আমি মনে করছিলাম, আমার এক একটি রবীন্দ্রসংগীত শোনার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা। সেই গান পরে অনেক বার শুনেছি, কিন্তু প্রথম বারের স্মৃতি মনের মধ্যে অতি উজ্জ্বল ভাবে জাগরুক।
সুহৃদ রুদ্র আর পরিমল চন্দ নামে দুই ভদ্রলোক ষাটের দশকে শুরু করলেন নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসংগীত উৎসব (নামটা ঠিক মনে নেই), সেটা আমাদের শহরের সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এখন চতুর্দিকে গানবাজনার এত রমরমা, তাই সেই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব হয়তো ঠিক বোঝা যাবে না, সারা বছর আমরা সেই উৎসবের জন্য উৎসুক হয়ে থাকতাম। প্রথম দিকে এই অনুষ্ঠান হত মহাজাতি সদনে, আমরা তরুণ কবির দল গিয়ে ভিড় জমাতাম সেখানে। কত বড় বড় গায়িকা-গায়করা আসতেন, তার মধ্যেও এক বার একটি বারো-তেরো বছরের বাচ্চা মেয়ের গান আর সবাইকে ভুলিয়ে দিল।
তখন আমাদের দু’জনেরই শরীর ও মন ফুর্তিময়, তবু এই গানটায় কেমন একটা করুণ সুর আছে না? ওই গানটি সে দিনই আমার প্রথম শোনা। ওতে একটি লাইন আছে,
ওগো সুখী দুখী, দাঁড়া মুখোমুখি’
আমাদের বিয়ের অত আগেই স্বাতী কী করে বুঝেছিল যে, সারা জীবনে আমাদের মাঝে মাঝেই সুখী-দুখী হয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.