মধু এবং বিধুর মধ্যে কে আদর্শ হইবার যোগ্য, ‘পূজার সাজ’ কবিতাটিতে সেই প্রশ্নের উত্তরে কোনও সংশয়ের ফাঁক নাই। মধু তাঁহার পিতার আনিয়া দেওয়া পোশাকে অখুশি হইয়া ধনীর গৃহ হইতে পোশাক জোগাড় করিয়া আনে। আর বিধু, বর্ণপরিচয়ের গোপাল-এর আদর্শে, বাপ-মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলিয়া নেয়। তবে লক্ষণীয়, উভয়ের আনন্দই নূতন পোশাকে। তখনও বালকদের নিকট নূতন পোশাক পূজার আনন্দের অন্যতম কারণ ছিল, এখনও তাহাই আছে। মধু-বিধু অপেক্ষা বয়সে কিছু বড় এক দল ছেলে যদি ঘোষণা করে যে তাহাদের পূজায় নূতন পোশাক চাই না, তাহারা সেই অর্থ একটি বিশেষ কারণে দান করিতে চাহে, তাহা হইলে প্রথমে বিস্ময় জাগে। তাহার পর সেই বালকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতে হয়। ঝাড়গ্রামের কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার ছাত্ররা এই ব্যতিক্রমী কাজটি করিল। তাহাদের সহপাঠী সুব্রত বারিক ক্যানসারে আক্রান্ত। তাহার পিতা-মাতার এই রোগের চিকিৎসা করাইবার সামর্থ্য নাই। বন্ধুরাই চিকিৎসার অর্থ সংস্থান করিবার দায়িত্ব লইয়াছে। তাহারা পূজার নূতন পোশাক, বেড়াইতে যাওয়া সবই এই বৎসর মুলতুবি রাখিয়াছে। আত্মকেন্দ্রিকতার ব্যাধিটি যখন সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিতেছে, তখন এই ছাত্রদের সিদ্ধান্তটি আশার আলো জাগায়। বোধ হয়, এখনও এই সমাজের প্রাণ আছে, এখনও চেতনা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় নাই। নিজের আনন্দ অপেক্ষা অপরের প্রয়োজনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার এই অধুনা-বিরল মানবিক গুণটি এই ছাত্রদের হইতে শিখিবার। এই ছাত্ররা হয়তো বিধুরও আদর্শ হইতে পারিত।
প্রশ্নটি শুধু পূজার পোশাক না কিনিয়া সেই টাকা বন্ধুর চিকিৎসার জন্য দেওয়ার নহে প্রশ্নটি আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডি অতিক্রম করার। আত্মকেন্দ্রিক হইয়া ওঠা সহজ। তাহা এই সময়ের শিক্ষাও বটে। নিজের, বা পরিবারের, বাহিরে যে বৃহত্তর সমাজ আছে, আমি তাহার কেহ নই, সেই সমাজও আমার কেহ নহে এই বোধটি ক্রমে সর্বজনগ্রাহ্য হইয়া উঠিতেছে। এই বোধটি বৃহত্তর সমাজের প্রতি এক ঔদাসীন্যের জন্ম দেয়। কলিকাতার সুনাম ছিল, এই শহরে কোনও মানুষ তাঁহার বিপদে নির্বান্ধব নহেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত কাহারও বিপদ দেখিলেও নাগরিকরা আগাইয়া আসেন, সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দেন। গত কয়েক বৎসরে অনেকগুলি ঘটনা প্রমাণ করিয়াছে, কলিকাতার সেই গর্ব এখন নিতান্ত অতীত।
ইহা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রত্যক্ষ ফল। যে মানুষটিকে আমি চিনি না, তাঁহার বিপদেও আমার কিছু কর্তব্য আছে আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা এই বোধটিকে পরিহাস করিতেও শিখাইয়াছে। ঝাড়গ্রামের স্কুলের ছাত্ররা এই আত্মকেন্দ্রিক সমাজে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তাহারা যে সহপাঠীর পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছে, সে ওই বিদ্যালয়ে নূতন আসিয়াছিল, মাত্র কয়েক মাস পূর্বে। সুতরাং, তাহার সহিত শৈশবের স্মৃতি ইত্যাদি না থাকাই স্বাভাবিক। আত্মকেন্দ্রিকতার যুক্তি বলিবে, অসুস্থ ছাত্রটি অন্য ছাত্রদের নিকট ‘অপর’। সেই অপরকে নিজেদের গণ্ডির বাহিরে রাখাই স্বাভাবিক ছিল। এই ছাত্ররা সেই ‘স্বাভাবিক’ পথে হাঁটে নাই। তাহাই ভরসা। আশা করা যায়, তাহারাই একমাত্র নহে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এমন ছাত্র, এমন মানুষ আরও আছেন। তাঁহাদের সংখ্যা যত দ্রুত বাড়ে, ততই মঙ্গল। |