বিতর্ক...
শারদোৎসব মানেই অপচয়
পক্ষে
বাড়তি খরচ, বড় ক্ষতি
পুজোর বাজার করতে গেলে সত্যই অর্থের অপচয়। কেননা অন্যান্য মাসে ক্রেতারা একই পোশাক-পরিচ্ছদ যে মূল্যে ক্রয় করে, পুজোর বাজারে সেই জিনিসেই দিতে হয় দ্বিগুণ মূল্য। প্রতিমা দর্শনে গাড়িভাড়া করার ক্ষেত্রেও বেশি রেট, পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিনিময়ে দু-মিনিট দেবীদর্শনে যেমন মনের শান্তি হয় না, তেমনই বিরাট সময়েরও অপচয়। এর পর রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে সামনে আসে মোটা অঙ্কের বিল। শারদোৎসবে যে হারে আতসবাজি, শব্দবাজি পোড়ে তা তো টাকা পোড়ানোর শামিল। আবার ছুটির ক’টা দিন বাইরে বেড়াতে গেলেও হোটেল ভাড়া অন্য সিজনের থেকে অনেক বেশি। আর, বিদ্যুতের যেখানে এত ঘাটতি, সেখানে মণ্ডপে মণ্ডপে অত্যধিক হারে আলোকসজ্জা বিদ্যুতের অপচয় নয় কি?
শুধু অপচয়ই নয়, সমাজ ও পরিবেশের পক্ষে একটা ভয়াল ও ভয়ঙ্কর দিক হল হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ ছোট বড় বৃক্ষের নিধন-যজ্ঞ। বিশাল বিশাল পুজোমণ্ডপগুলি আমাদের শিল্পকলাকে অনেক উচ্চস্থানে বসালেও অরণ্যসম্পদের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। যে ভাবে বনজ সম্পদ নির্বিচারে বিনাশ হয় তা বন্ধ না-করলে এর প্রভাব পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবশ্যই ব্যাঘাত ঘটাবে। পরন্তু মণ্ডপে ব্যবহৃত অপরিণত কচি কচি গাছের কাঠ ভবিষ্যতে আসবাবপত্রের কোনও কাজেও বিশেষ লাগে না। একটা ছোট্ট ও সাধারণ হিসাব থেকেই বোঝা যাবে কী বিপুল পরিমাণ বনজ সম্পদ ব্যবহৃত হয় এই শারদোৎসবের মরসুমেই। কলকাতার বুকেই প্রায় তিন হাজার ছোট-বড় ও মাঝারি মাপের মণ্ডপ তৈরি হয়। এদের প্রত্যেকটিতে যদি গড়ে দুশো বাঁশ ও পাঁচটি করে মাঝারি মাপের গাছের গুড়ি থেকে তৈরি বাটাম ও পঁচিশ বর্গফুট করে প্লাইউড বোর্ড ব্যবহার করা হয় তবে ছয় লক্ষ বাঁশ, পনেরো হাজার ছোট বড় গাছ ও পনেরো লক্ষ বর্গফুট প্লাইউড বোর্ডের অপচয় হয়। এ ছাড়া সমগ্র রাজ্যের প্রায় তিরিশ হাজার গ্রামের ও বহু ছোটখাটো শহরের প্রত্যেক জায়গায় যদি একটা করেও পুজোমণ্ডপ তৈরি হয় তবে কী বিপুল পরিমাণ বনজ সম্পদের অপচয় হতে পারে? তা ছাড়া, কালী ও জগদ্ধাত্রী পুজো তো আছেই। বনভূমি অপচয় ছাড়া কালীপুজো ও দীপাবলি উৎসবের সময় বিপুল পরিমাণে কোটি কোটি টাকার আতসবাজি ও শব্দবাজির ব্যবহারও বিশাল অপচয় শুধু নয়, পরিবেশ আর শব্দ দূষণ তো বটেই, বাতাসে ওই সময় যে পরিমাণ দূষিত রাসায়নিক গ্যাসের উদ্গিরণ হয় তা জনস্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকারক এবং বিপজ্জনক। তার উপর আছে ব্যাপক বিদ্যুৎ শক্তির অপচয়, যে বিদ্যুৎ আমাদের শিল্পের কাজে লাগানো যেত।
পুজো মণ্ডপ তৈরির জন্য বিকল্প পথের সন্ধান যেমন, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়ম শিট বা ওই জাতীয় কোনও ধাতব পদার্থ এবং জৈব রাসায়নিক সামগ্রী ব্যবহার করলে এক দিকে যেমন বনভূমি রক্ষা পাবে, অপর দিকে বিকল্প ব্যবহৃত সামগ্রীর রিসাইক্লিং বা পুনর্নবীকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে ওই বস্তুগুলির পুনর্ব্যবহারেরও সম্ভাবনা থাকে।

মণ্ডপের বাজেট নিয়ে আমরা যতটা উৎসাহী পাড়ার স্কুলের উন্নতি নিয়ে ততটা আগ্রহী নই। প্রতি বছরই বন্যার ভয়াল রূপ দেখার পরে শারদোৎসবের উচ্ছ্বাসকে লজ্জাকর মনে হয়। ঘরের উপার্জনকারী মানুষটির কাছে এই হাঁসফাঁস করা মাসটা একটা বাড়তি খরচের সময়।
বিপক্ষে
হ্যারিকেন-আলোয় হাসি ফুটবে?
একের কাছে যা অপচয় অন্যের কাছে তা সঞ্চয়। এক শ্রেণি যা দেয় অন্য শ্রেণি তার থেকেই ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করে। উৎসব হল মেলবন্ধন। এই মেলবন্ধন যেমন পারিবারিক উৎসবের ক্ষেত্রে দেখা যায় তেমনই সর্বজনীন উৎসবের ক্ষেত্রেও। আগে ধনীরা দরাজ হাতে শারদোৎসবে অন্ন বস্ত্র বিতরণ করতেন, তা গ্রহণ করতেন দরিদ্র মানুষজন। শারদোৎসব এমন একটা উৎসব যাকে সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে। উচ্চশ্রেণি থেকে নিম্নশ্রেণি পর্যন্ত। অর্থ বণ্টনের এমন সুব্যবস্থা আর কোনও উৎসবে দেখা যায় না। মালাকার থেকে হকার, ঢাকি থেকে পুরোহিত কেউ বাদ যায় না। প্যান্ডেল, মাইক, আলোকসজ্জা ইত্যাদি বাদ দিয়ে যদি কেউ হ্যারিকেনের আলোয় শারদোৎসবের আয়োজন করে তবে তা প্রকৃত অর্থে উৎসব হবে কি? ছোট বড় সবার মুখে এই অপচয় হাসি ফোটাতে পারবে কি? শারদোৎসব অপচয় নয়। শারদোৎসব যদি অপচয় হয়, তবে পারিবারিক, সামাজিক সব উৎসবকেই অপচয়ের দায়ে দোষী করা যেতে পারে।
শারদোৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ হয় এ কথা মানছি। কিন্তু তার চাইতে বহু গুণ বেশি অর্থ ঢালা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের ‘নির্বাচনী উৎসবগুলি’-তে। উৎসবের দিনগুলিতে আমরা একঘেয়ে জীবনের বাঁধন কেটে বেরিয়ে পড়ি অন্য এক আলোর জগতে। যেখানে শিল্প কারুকার্য আছে, ব্যবসা-বিকিকিনি আছে। আছে অল্প দিনের জন্য হলেও বহু মানুষের রুটিরুজির সুযোগ। আছে বিনোদন। কিন্তু নির্বাচনী উৎসবগুলিতে আমরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে কী পাচ্ছি? হ্যাঁ, পাচ্ছি অপদার্থ নেতা-মন্ত্রী, সন্ত্রাস। কালো টাকার ধনকুবের। আবার তাদের উত্তম শিক্ষাদানের জন্য বিশিষ্ট সমাজসেবীদের নীতিশাস্ত্রের পাঠশালা খুলে বসতে হচ্ছে দিল্লির রামলীলা ময়দানে। সেখানও রীতিমত উৎসবের মেজাজ, অর্থের ছড়াছড়ি।
তা হলে মা দুগ্গার সন্তানদের আর দোষ কোথায়? প্রতিমা শিল্প, মণ্ডপ শিল্প, অভিনব আলোকসজ্জায় পারদর্শী শিল্পরসিক বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার মতো বিরাট মঞ্চ এই উৎসব। এর জন্য বোধহয় দিকে দিকে শুরু হয়ে গেছে থিম পুজোর লড়াই। এটাও আমার কাছে একটা ভাল দিক। কেননা, আমরা টাকা ঢালছি উৎকর্ষতার লড়াইয়ে, আনন্দের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রভূমিতে।
শারদোৎসব মানেই যদি অপচয় হয়, তা হলে অন্য যে কোনও উৎসবও অপচয়। বাবার শ্রাদ্ধে হাজারখানেক কুটুম্বাদি ভোজন, ছেলের বউভাতে জম্পেশ প্রীতিভোজ এগুলিই বা কী দোষ করল? সমস্যাক্লিষ্ট একঘেয়ে জীবনে যদি বছরে এক বার আপামর মানুষ একটু সর্বজনীন আনন্দে মেতে উঠতে পারে, তা হলে সেই মুগ্ধতার দামটুকুই বা কম কীসে!
আড়ম্বর কমালে কি অর্থনৈতিক অসাম্য কমবে? যাদের অনেক আছে তারা এই মুগ্ধতার আয়োজনে কিছু করুক না ‘অপচয়’! সেই অপচয়ের কিছুটা তো পাবে গ্রামের গরিব ঢাকি, দশকর্মা ভাণ্ডারের খুচরো ব্যবসায়ী, কুমোরপাড়ার মূর্তিশিল্পী, ডাকের সাজের কারিগর, প্যান্ডেলওয়ালা, আলোকসজ্জার মিস্ত্রি, এমনকী গলা জলে নেমে পাঁক থেকে পদ্ম তুলে আনা হাভাতে কিশোরটিও। যা কোনও না কোনও ভাবে মানুষের ‘রুজি’ ও ‘আনন্দে’র সহায়ক। তাকে ‘অপচয়’ বলে ‘মহৎ’ সাজার অভিপ্রায় আমার নেই।

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আমরা বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। তাই এই শারদোৎসব বা অন্যান্য বারোয়ারি পুজো-পার্বণ খুবই প্রয়োজন। এই শারদোৎসবের সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা কিছু সময়ের জন্য মানুষকে সামাজিক করে তোলে। মনে করিয়ে দেয়, আমরা সামাজিক প্রাণী। অপচয় কথাটা তো আপেক্ষিক। ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা, পুজোর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিযোগিতা করার জন্য অন্যায় ভাবে টাকা জোগাড় না করলেই হয়।
নভেম্বর মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ অক্টোবরের মধ্যে এই ঠিকানায়
নভেম্বর মাসের বিতর্ক, সম্পাদকীয় বিভাগ,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.