চল আকাডেমিতে নাটক দেখে আসি! শেষ কবে এ কথা উচ্চারিত হয়েছে, মনে পড়ে না!
অফিস ফেরতা কলামন্দিরে গিয়ে গান শোনা! সে-ও তো নস্টালজিয়া শুধু।
নজরুল মঞ্চে বাংলা ব্যান্ডের সঙ্গে উন্মত্ত হওয়া! কোন সুদূর সেই স্বপ্নপুর!
এর পরেও পুজোর এই চারটে দিন ছাড়া যায়? সন্ধে থেকে ভোর দিল্লির এ মাথা ওমাথা করে, গাড়ি ছুটিয়ে, মেট্রো চড়ে যতটা পারো দেখে নাও! শুনে নাও! নইলে আরও একটা বছরের হাপিত্যেশ!
প্রবাসে এই তো বাঙালির ‘থিম পুজো’।
রাজধানী দিল্লিতে ক্রমবর্ধিষ্ণু বাঙালি পরিবারের এ পরম্পরা নতুন নয়! দেখতে দেখতে তিরিশ-চল্লিশ বছর হতে চলল। তখন রাতভোর নাটক হত চিত্তরঞ্জন পার্কের পাড়ায় পাড়ায়। মাঠে টাঙানো সাদা পর্দায় প্রোজেক্টরে ভেসে উঠতেন-উত্তম-সুচিত্রা। তাতেই আহ্লাদে আটখানা। পর দিন মণ্ডপে গত রাতের গল্প নিয়ে মশগুল আড্ডা।
সময়ের সঙ্গে পা ফেলে পুজো বেড়েছে। চাঁদা বেড়েছে। গুগ্ল করলে দেখা যাবে বাঙালি পরিবারও বেড়েছে। গুড়গাঁও থেকে নয়ডা, ফরিদাবাদ থেকে রোহিণী নয় নয় করে রাজধানীতে বাঙালি এখন দশ লাখের গণ্ডি পেরনো ‘মুষ্টিমেয়’। প্রোজেক্টরের প্রযুক্তি পিছনে রেখে তাঁদের পুজোয় সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি বেড়েছে। বাংলা ব্যান্ড-টলিউড-অ্যাকাডেমিকে দিল্লিতে হাজির করার সাধ এখন সাধ্যে পরিণত। এ বারও তাই হচ্ছে!
কলকাতা থেকে কারা কারা এ বার এলেন? |
তা হলে শুনুন! চন্দ্রবিন্দু, শহর, স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত, অনুপম রায়, শমীক, ইন্দ্রাণী সেন, গৌতম হালদার, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্তরা চৌধুরী, স্বপন বসু...দীর্ঘ তালিকা।
আর তাঁদের গান-কথা-সংলাপ শুনতেই সকাল থেকে আগ্রহ ভরে অপেক্ষা। এস এম এস করে বন্ধুকে জানানো, ‘পকেট ফর্টিতে চলে আয়, আজ সাড়ে আটটায় অনুপম!”
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাহুলের কথাই যদি ধরি। ‘‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও প্রথমে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে শুনেছি। পরে সিডি কিনেছি।” সেই অনুপম মঞ্চে যখন উঠলেন এই রাহুলের আবেগ-উচ্ছ্বাস বাঁধ ভাঙল। “দেখলেন, ‘সাঁতরে পার খোঁজার’ লাইনটা কেমন ইমপ্রোভাইজ করে গাইল?” শুধু অনুপমের অনুষ্ঠান নয়, কমবেশি সব অনুষ্ঠানেরই ছবিটা এমনই।
পুরনো চাল যে ভাতে বাড়ে, তা আরও একবার প্রমাণ করে দিল চন্দ্রবিন্দু। পঞ্চমী থেকে অষ্টমী চার দিন ‘দুধ খাওয়ানোর’ আর্জি না শুনলে জুজুর ভয় দেখিয়ে শ্রোতাদের মজিয়ে রেখেছিলেন অনিন্দ্য-উপলেরা। গ্রেটার কৈলাস-পটপরগঞ্জ থেকে নয়ডা চন্দ্রবিন্দুর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি এত বছরেও। শুধু এরাই নয়! মন্দির মার্গে রয়েছেন ইন্দ্রাণী সেন। নবপল্লি ও নয়ডা সেক্টর ৫০-এ থাকছেন শ্রাবন্তী সেনের অনুষ্ঠান। নয়ডার বসুন্ধরা এনক্লেভ মাতিয়ে দিয়েছেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লির ছয় বাঙালি মিলে ১৯৮০ সালে তৈরি করেছিলেন ‘স্পেকট্রাম’ নামে একটি ব্যান্ড। টুজি নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক, ব্যান্ড ‘স্পেকট্রামে’র গানে কিন্তু মুগ্ধ নিবেদিতা এনক্লেভের বাসিন্দারা। এ ছাড়া মেদিনীপুরের ‘ওয়ান্ডার বয়েজ’ও যথেষ্ট নাম কিনেছে দিল্লির বাজারে ওই পুজো কমিটির অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ভোজনরসিক বাঙালির রসনা তৃপ্তিতেও পিছিয়ে নেই দিল্লির পুজোগুলি। কোমরে আঁচল বেঁধে নেমে পড়েছেন পাড়ারই কাকিমা বা বৌদিরা। বাড়িতে বছরভর বেজার মুখে হাঁড়ি ঠেললেও এই ক’টা দিন ছবিটা উল্টে যায়। ‘দত্ত গিন্নির ঘুগনিতে নুন বেশি’ কিংবা ‘ধর কাকিমার দইবড়াটা খাসা’। পটেলনগর পুজো কমিটির সম্পাদক শেলী ভৌমিকের কথায়, “আগে সপ্তমী থেকে এই স্টলগুলো চালু হত। এ বছর ষষ্ঠী ছুটির দিন বলে এক দিন আগে থেকেই বিক্রিবাটা শুরু হয়ে গিয়েছে।” এ ছাড়া দুপুরে রয়েছে পাড়ায়-পাড়ায় ভোগের আয়োজন। বেঁচে যাওয়া খাবার পূর্বাঞ্চলে যেমন বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় বাচ্চাদের মধ্যে। বসুন্ধরা এনক্লেভ আগে থেকেই ভোগের একটি অংশ তুলে রাখছেন স্থানীয় একটি বৃদ্ধাশ্রমের জন্য। তবে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের পরে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তাটা থাকছেই। পটপরগঞ্জ পূর্বাচলের সভাপতি দুর্গাদাস দত্ত বলেন, “নিরাপত্তার কড়াকড়িতে রাত দশটা বাজলেই অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হচ্ছে। মেটাল ডোর ফ্রেম, বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী থাকলেও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে রাজি নয় কোনও শিবির।” |