ভিড়ের ভরা জোয়ারেও
প্রশ্নের মুখে থিমের একঘেয়েমি
‘ভূমিকম্পটাই যা বাদ পড়ে গেল! নেহাত পুজো কমিটিগুলো ঢের আগে থিম ঠিক করে ফেলেছিল তো।’
মহাষ্টমীর সন্ধেয় কালীঘাট অঞ্চলের মণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে মোবাইল থেকে ‘টুইট’ করলেন ছুটিতে কলকাতায় আসা প্রবাসী যুবক। সঙ্গে সঙ্গে এই মন্তব্যের পিঠে সমর্থনের বন্যা। হায়দরাবাদ থেকে বৃদ্ধা আত্মীয়া, নিউ জার্সি-ভ্যাঙ্কুভারে স্কুলের পুরনো বন্ধু থেকে শুরু করে দেশে-বিদেশে চেনা-অচেনা অনেকেই সহাস্যে কলকাতার পুজো নিয়ে আড্ডায় যোগ দিলেন।
বিকেলের দিকে ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় দক্ষিণ কলকাতায় মণ্ডপ-অভিযান চলার সময়ে সদানন্দ রোডের পাশ দিয়ে বড় পুজোর মণ্ডপে পৌঁছে গিয়েছিলেন উত্তরের কলেজছাত্রী মিতালি দত্ত। দড়ির সাজের মণ্ডপসজ্জা দেখতে দেখতে দূর থেকে সাদা ধবধবে এলোকেশী প্রতিমার একটি ঝলক পেয়েই সটান পিঠটান দিলেন তিনি। ‘ধুর, ঠাকুরের মা-মা ভাবটা না-থাকলে ভিড় ঠেলে এত হ্যাপা পোষায় কি?’ থিমের টানে সেই তৃতীয়া থেকে এ শহরের এ-মাথা ও-মাথা চষে বেড়ানোর হিড়িকেও দর্শকদের একাংশের মধ্যে পুজোর থিম নিয়ে প্রশ্ন দানা বাঁধছে।
এত পরিশ্রম করে রাত জেগে ঘামতে ঘামতে এই মণ্ডপ-সফর কতটা যুক্তিযুক্ত?
থিমের সঙ্গে দুর্গাপুজোর কী সম্পর্ক? আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি?
উত্তরের খোঁজে মাথা ঘামাচ্ছে কলকাতা।
সেরা মণ্ডপ, সেরা প্রতিমা বাছাইয়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বছরের পর বছর যাঁরা বিচারকের ভূমিকায়, তাঁরাও কেউ কেউ এই থিমের একঘেয়েমিতে ক্লান্ত। প্রশ্ন উঠছে, থিমের পরিসরে শিল্পীরা স্বাধীন ভাবে কাজের সুযোগ পেলেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে কি পুজোর মূল বিষয়টাই গৌণ হয়ে যাচ্ছে না?
থিম-পুজোর এক সফল শিল্পী পূর্ব কলকাতার একটি মণ্ডপে ফেডেড জিন্সের সাজের কাজ করেছেন। ঠাকুরের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়েও এলইডি আলোর তীব্র তাপে দ্রুত বেরিয়ে এলেন বিচারক। ভাবনায় মৌলিকতা থাকলেও পুজোর সামগ্রিক আয়োজন বা সাজসজ্জার ‘নাটুকেপনা’ নিয়ে সমালোচনার সুর শোনা গেল। শিল্পীর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না-থাকলেও পাখির বাসার মধ্যে ধাতব ডিমের আদলে একটি মণ্ডপ কোনও কোনও বিচারকের উদ্ভট ঠেকেছে।
আবার বাঘা যতীন উদয়ন সঙ্ঘের পুজোয় কোনও রকম রংবিহীন বেলের খোলের মাতৃমূর্তি কারও কারও নজর কেড়েছে। কাজটা কলকাতার পুজোয় একেবারে মৌলিক নয়, তবে বেলের খোল চেঁছে রঙের হেরফেরে প্রতিমা একেবারে নিখুঁত। প্রবীণ শিল্পী এক বিচারক সস্নেহে বাঁকুড়ার অখ্যাত মূর্তিকার প্রশান্ত দাসের মাথায় হাত রাখলেন। থিম-যুদ্ধের রেষারেষির বাইরে কলকাতার পুজোর একটি বিশেষ মুহূর্ত রচিত হল।
শিল্পী যোগেন চৌধুরী বহু বছর ধরেই পুজোর বিচারকের ভূমিকায়। এ কালের পুজোর ‘প্রতিযোগিতা-সর্বস্ব’ হয়ে ওঠার অভিযোগ তাঁকেও ব্যথিত করে। যোগেনবাবুর কথায়, “শিল্প, নান্দনিকতা সব বুঝলাম। কিন্তু ঠাকুর দেখে ভিতরে একটা ভক্তিভাব না-জাগলে সব বৃথা।” থিম-শিল্পীদের অনেকের সৃষ্টিশীলতার প্রশংসা করলেও তিনি মানছেন, কোনও কোনও পুজোয় প্রতিযোগিতায় জেতার ঝোঁকটাই বড় হয়ে উঠছে।
কলকাতার পুজোর আর এক পোড়খাওয়া বিচারক তথা বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু ঘোর থিম-পন্থী। থিম-পুজোর বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, “কেন, সাবেক পুজোয় বুঝি একঘেয়েমি নেই? তা ছাড়া থিমেও লোকশিক্ষা হয়।” সুব্রতবাবুর দাবি, থিম-পুজোর জন্যই কলকাতার পুজোর পরিবেশ ঢের ভাল হয়েছে। তিনি বললেন, “আজকাল থিমের জন্যই পুজো-মণ্ডপে হিন্দি গান-টান প্রায় বন্ধ।”
থিম থিম! থিম তোমার মা-মা ভাব কিংবা ভক্তিভাব নেই?
অনেকের কাছেই থিম হল, পুজো ঘিরে শিল্পীর সুররিয়ালিস্টিক বা পরাবাস্তব ভাবনার প্রকাশ। বেহালার বড়িশা ক্লাব কি কাঁকুড়গাছির মিতালি-র জ্যামিতিক মণ্ডপ এ বার নজর কাড়ছে। হিন্দুস্থান পার্কের পুজোয় কাচে ঠিকরে পড়া আলোর জৌলুসও তো সেই থিমের ফসল। খিদিরপুর ২৫ পল্লির মণ্ডপে রং আর আলোর রসায়নে রাতেও দিনের আবেশ। রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘে মাটি থেকেও আলো ঠিকরোচ্ছে।
থিম নিয়ে বিচিত্র মতের মধ্যেই পুজো কমিটিগুলোর মধ্যেও টানাপোড়েনের চোরাস্রোত। থিম থেকে সাবেকিয়ানা আর সাবেকিয়ানা থেকে থিমে গতায়াতের খামতি নেই। যোধপুর পার্কের পল্লিমঙ্গল এ বার থিম ছেড়ে সাবেকিয়ানায় ফিরছে। সল্টলেকের জি-সি ব্লকের পার্কটা আগে পুজোর থিমের কারিকুরিতে ভরে উঠত। এ বার সেই পার্কেই ম্যারাপ খাটিয়ে ম্যাডক্স স্কোয়ার-মার্কা আড্ডার পরিবেশ। উত্তরের কাশী বোস লেন আবার হঠাৎ সাবেকিয়ানা ছেড়ে থিম-পন্থী। এই পুজোর চিরকেলে থিম, আচারনিষ্ঠতা ও প্রসাদী ভোগের উৎকর্ষ থাকলেও আসন্ন ৭৫ বছরের উৎসবের আগে এক বার মণ্ডপের থিমের ফর্মুলা পরখ করে দেখা হচ্ছে।
থিম আঁকড়ে খুব কম বাজেটে ভাল কাজের একটি নিদর্শন এ বারের তেলেঙ্গাবাগান। রূপকার কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত স্রেফ কয়েকটি রঙিন বাঁশ নিয়ে খেলতে খেলতে মণ্ডপ সাজিয়ে ফেলেছেন। ছিমছাম সাজের মণ্ডপে নবপত্রিকার তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী রঙিন বাঁশের সাজ সৃষ্টিশীল তাগিদের প্রতীক। নীচে জাগতিক স্তর বোঝাতে ছোট ছোট খেলনায় গাড়ি-বাড়ির মতো বৈষয়িক চাহিদার স্মারক। রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে লালাবাগান নবাঙ্কুরের পুতুল-রাজ্যও চোখ জুড়িয়ে দেয়। শ্যামবাজার নবীন সঙ্ঘের তস্য গলিতে গ্রামবাংলার ঘরোয়া বাঁশের ফ্রেম ঢাঢরায় শিল্পকলার প্রকাশ।
তেমন কিছু বৈভবের ছোঁয়া নেই, কিন্তু হাটখোলা গোসাঁইপাড়ার মণ্ডপে স্নিগ্ধ প্রতিমার সামনে দাঁড়ালেও তো বুকের মধ্যে কান্না দানা বাঁধে। সমকালের নারীর সাফল্য ও যন্ত্রণার পুরো ছবিটাই ছোট ছোট শোলার মডেলে তুলে ধরা হয়েছে। পণপ্রথা বা ধর্ষণের মতো সমস্যার ছবিও অসম্ভব পরিমিতির সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিষয়-ভাবনায় বীভৎসতা এড়িয়ে সহমর্মিতা বজায় রয়েছে। পাইকপাড়ার তেরোর পল্লিতে মণ্ডপের পাশের বাড়িগুলোতেও থিমের দরুন আলপনার ছোঁয়া। গড়িয়ার কেন্দুয়া শান্তি সঙ্ঘের আয়লা-বিধ্বস্ত গ্রামটি কলকাতার মনে থাকবে। চার পাশের দারিদ্রের সঙ্গে মিলিয়ে যেখানে দেবীরও গ্রাম্য মলিন বেশ।থিম বনাম সাবেকিয়ানার লড়াইয়ে তা হলে জিতল কে? থিমের বিরুদ্ধে অজস্র যুক্তি ঝড় তুলছে।
মহাষ্টমীর রাতে সন্ধিপুজোর পরেও বেহালার নূতন দলের নকল জমিদার বাড়িতে উপচে পড়া ভিড়।কাছেই বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদের ঠাকুরদালানে তখন একটিমাত্র মাটির প্রদীপ একলা প্রতিমাকে সঙ্গ দিচ্ছে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.