লিটল ম্যাগ সম্পাদক মানেই মেঘে ঢাকা তারা: ‘আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’?
প্রথমেই চাই দৃষ্টিভঙ্গির বদল। চাই বাস্তববোধ।
ইন্দ্রজিৎ রায় |
বড় প্রকাশনা সংস্থার পুজোসংখ্যাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে একগুচ্ছ লিটল ম্যাগাজিনও পুজোর সময় প্রকাশ পায়। এত লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশ দেখে বাইরে থেকে মনে হতে পারে এদের ‘বাজার’ নিশ্চয়ই রমরমা। কিন্তু আদতে, অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিনের একটা সংখ্যা প্রকাশ করতেই সম্পাদক-প্রকাশকের নাভিশ্বাস ওঠে, প্রায় কোনওটাই ধারাবাহিক ভাবে নির্দিষ্ট সময়ে বেরোয় না, অনেকগুলোই কয়েক বছর চলার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণটা মূলত অর্থনৈতিক।
সম্প্রতি একটি লিটল ম্যাগাজিনের পনেরো বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সভায় আলোচিত হল ‘লিটল ম্যাগাজিনের আয়ু এবং অর্থনীতি’। এই সভায় কথা বলার আমন্ত্রণ পেয়ে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে জড়িত কয়েক জনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তা বলে আগে সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। এ কাজে নেমে জানলাম এমন কাজ আগেও হয়েছে। ওই পত্রিকারই সাম্প্রতিক সুভাষ ঘোষাল স্মরণ সংখ্যাতে দেখলাম আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও তারও আগের ত্রিশ বছরের (১৯৫০-১৯৮০) বাংলা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে এক প্রদর্শনী করেছিলেন। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত এক পুস্তিকায় তৎকালীন চৌত্রিশ জন পত্রিকা সম্পাদকের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সাক্ষাৎকারগুলি প্রশ্নাকারে লিটল ম্যাগাজিনের সমস্যাগুলোকে সামনে এনেছিল ঠিকই, কিন্তু সমাধানের চেষ্টা যে হয়নি, ত্রিশ বছর পরে সমস্যার একই রূপ তার প্রমাণ দেয়।
সে দিনের সাক্ষাৎকারে উঠে আসা সমস্যাগুলো দেখলাম ত্রিশ বছর পরের নতুন প্রজন্মের সম্পাদক-প্রকাশকের কাছেও একই রকম আছে। এখনকার সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলে, অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে মনে হল, এ সবই আধুনিক অর্থনীতির, মূলত মাইক্রোতত্ত্বের, পাঠ্যপুস্তকের পাতা থেকে যেন তুলে আনা। ছোটখাটো প্রান্তিক কিছু অভিযোগ বাদ দিলে মূলত তিনটে কারণে লিটল ম্যাগাজিন চালাতে অসুবিধে হয়, এমনকী বন্ধও করে দিতে হয়। |
এক, সময়মত ও নিয়মিত উপযুক্ত লেখা মেলে না; যে লেখা না চাইতেই মেলে সেগুলো ছাপার যোগ্য নয়। আর যে লেখা (তা সে নামী-অনামী, যে লেখকেরই হোক না কেন) সম্পাদক ছাপতে চান সে লেখা জোগাড় করতে জুতোর সুখতলা খুলে যায়। দুই, পত্রিকা চালানোর সঙ্গে জড়িত জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সমস্ত কাজ সম্পাদক একলা নিজেই করেন হয় নিজে করতে বাধ্য হন (বড়জোর দু’তিন জনের কাছ থেকে সাহায্য মেলে, কোনও ক্ষেত্রে তাও মেলে না) অথবা অন্যের কাজ নিজের পছন্দসই হবে না বলেই নিজে করেন। তিন, একে পত্রিকার বিক্রিবাটা কম, তার ওপর পত্রিকার মোট খরচের যে পঁচিশ শতাংশ মতো হয়তো বা বিজ্ঞাপন থেকে আসত, সেটাও কয়েক সংখ্যা পরে ক্রমশ মিলিয়ে যায়। তখন নিজের পকেটের বা সহৃদয় পৃষ্ঠপোষক, বন্ধুদের দানের টাকায় কিছু দিন চালানো গেলেও এ ভাবে বেশি দিন পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না; সরকারি, বেসরকারি অনুদান সরাসরি মেলে না কিংবা, অনেকেই নীতিগত ভাবে ও আদর্শের খাতিরে এ রকম দান গ্রহণ করতে চান না।
গল্পটা অবশ্য অন্য। সমস্যাগুলোর সমাধান কেউই আসলে জানতে চান না। লিটল ম্যাগ সম্পাদক মানেই মেঘে ঢাকা তারা ‘আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’ কথাটা শেষ দৃশ্যে মরণের আগে না এলে তাঁদের মুখ ফুটে বলতে বাধে। এঁদের অবস্থা অনেকটা বাণিজ্যিক সিনেমার পাশে তথাকথিত আর্ট-ফিল্মের মতো। শিল্পগুণে হয়তো এঁরা শতগুণ এগিয়ে, কিন্তু আর কোনও মাপকাঠিতেই নয়; আর তার যে প্রয়োজন আছে তাও তাঁরা মানেন না। অনেকে তো আবার গর্ব করে বলেন, এ ভাবে না চললে আর লিটল ম্যাগাজিন বলব কেন, তা হলে তো প্রতিষ্ঠিত হাউস-পত্রিকাই হল। অতএব লিটল ম্যাগের সমস্যা সমাধানের প্রথম শর্তই হল এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত সকলকেই আরও বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। শুরুতেই প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টিভঙ্গির বদল।
অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হয় দু’চার জন লেখককে কেন্দ্র করে। সুভাষ ঘোষালের ভাষায় বললে, নবীন লেখকরা চান ‘নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে বলার জন্য একটি পত্রিকা বানাব।’ দুর্জনেরা অবশ্য বলবেন নামী কাগজে লেখা ছাপা হয় না বলেই নতুন লেখকরা নিজেদের পত্রিকা খুলে বসেন, যাতে নিজেদের লেখার ওপর কেউ কলম চালাতে না পারে। মূলত নিজেদের লেখা ও কিছু প্রতিষ্ঠিত লেখকের কাছ থেকে আমন্ত্রণমূলক লেখা নিয়েই পত্রিকা চলে। এই গত ভাঙার সময় এসেছে। লেখক সম্পাদক প্রকাশক এঁদের কাজগুলো আলাদা আলাদা ভাবে করা হোক। লেখক লিখুন, সম্পাদক লেখার গুণমান বিষয়ে মন দিন, প্রকাশক তার পরে প্রকাশনার দায়িত্ব নিন। এক ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রয়োজনে অন্য ম্যাগাজিনেও লিখুন, রেফারিং করুন কিন্তু প্রকাশনায় মাথা না ঘামানোই ভাল। প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে হবে; যে ভাবে তৈরি পাণ্ডুলিপি থেকে বই হয়, সে ভাবেই সম্পাদকের গুছিয়ে দেওয়া ম্যাগাজিন প্রকাশ পাবে প্রকাশকের হাতে। বিদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলো এ ভাবেই একই ঘর থেকে অজস্র জার্নাল, ম্যাগাজিন ছাপে।
ভিন্ন ভিন্ন ক্রেতার কাছে পত্রিকার দাম একই হবার কোনও কারণ নেই। এক পণ্য, ভিন্ন মূল্য হতে পারে, এই দাম নির্ধারিত হবে আধুনিক অর্থনীতির তত্ত্ব সাপেক্ষে, পরিভাষায়, ‘প্রাইস ডিসক্রিমিনেশন’-এর মাধ্যমে। যেমন কোনও গোষ্ঠীর সদস্যরা এক মূল্য দেবেন, সাধারণ পাঠক আরও একটু বেশি, লাইব্রেরিগুলি কিনলে আরও বেশি। সরকার সরাসরি বিজ্ঞাপন বা অনুদান না দিয়ে বরং পরোক্ষে সাহায্য করুক, সরকারি লাইব্রেরিতে পত্রিকা কেনা হোক বেশি দামে।
পত্রিকার জন্যে কাজের, বা পরোক্ষে ব্যয়িত সময়ের যথাযথ দাম আমাদের বাজারে মেলে না। স্কুলে সরস্বতী পুজো আয়োজনের জন্য বাহবা মেলে কিন্তু পত্রিকা চালানোর মতো বুনো মোষ তাড়ানোর কাজের কোনও স্বীকৃতি নেই। সঙ্গে সঙ্গে, পত্রিকা লেখার, সম্পাদনার বা প্রকাশনার যে আনন্দ বা সুখ, পরিভাষায় যাকে বলে ইউটিলিটি, তারও কোনও গাণিতিক মূল্যায়ন হয় না। এই সব সময়ের, কাজের মূল্যায়ন হোক স্কুল শিক্ষক বা ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা নিজের কাজের মধ্যেও ম্যাগাজিন চালানোর স্বীকৃতি যাতে পান। পত্রিকা গোষ্ঠী সংস্থা গড়ে তুলুক, সহজ পদ্ধতিতে। রেজিস্টার্ড চ্যারিটি হিসেবে সরকার তাদের আয়কর ছাড় দিক, সময়ের মূল্যের বদলে। লিটল ম্যাগাজিনের পরিপূরক হিসেবে এখন বেশ কিছু ওয়েবজিন (শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ পায়, ছাপা হয় না এমন ম্যাগাজিন) তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে, হয়তো বা কোনও পত্রিকাই আর ছাপা হবে না, সবই ওয়েবসাইটে থাকবে। তা যদি নাও-ও হয়, কম খরচে (প্রায় বিনামূল্যে) সকলের কাছে পৌঁছনোর সহজ উপায় আন্তর্জাল। বড় প্রকাশন সংস্থা থেকে ম্যাগাজিন প্রকাশ পেলে, ধরে নেওয়া যায়, সকলেরই ওয়েবসাইট থাকবে। এ ভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে আন্তর্জাতিক বাজারও সহজে করায়ত্ত হবে লিটল ম্যাগাজিন সে দিন আর লিটল থাকবে না। |
অহর্নিশ পত্রিকার ১৫ বছর পূর্তির সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার ভিত্তিতে রচিত।
তথ্য: সুভাষ ঘোষাল সংখ্যা, অহর্নিশ ২০১১ |