প্রবন্ধ ২...
আমরা কেমন আছি
এই রাজ্য, এই শহর
ট্রেনটা মহানায়ক উত্তমকুমার ইস্টিশানে ঢুকল আর আঁধার হল কামরা। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নয়, তবে বইপড়া স্থগিত রইল। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখা গেল, নিভে আছে পাঁচটি টিউবলাইট। নতুন কিছু নয়। প্রায়ই ঘটে এমন। পাখা চলে না। আলো জ্বলে না। পায়ের তলায় ধাতব মেঝে গরম ছ্যাঁকা দেয়। বহু ব্যবহারে জীর্ণ যন্ত্রপাতি বিদ্রোহে জ্বলে ওঠে। ধোঁয়া। পোড়া গন্ধ। এবং অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ মেট্রো পরিষেবা। ভিড়ে দম আটকে আসা সফরের কথা আর না-ই বা তুললাম। বাসযাত্রায় যে পথ অতিক্রম করতে দেড় ঘণ্টা লাগত, মেট্রোয় তাতে লাগে ত্রিশ মিনিট। এতখানি পরিষেবা পাবার পরেও বই পড়তে পারিনি বলে নাকে-কান্নায় কানই দেবে না কেউ। আচ্ছা, খুচরো নেই বলে ন’টাকার টিকিটের জন্য কেউ যদি সাত টাকা দেয়, রেল শুনবে? খবরে প্রকাশ, দোতলা রেল আসছে। ভিড় একটু কমবে বোধহয়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি আরামদায়ক। আর ক’টা পেলে ভাল হত। কিন্তু ব্যয় বাড়ালে টিকিটের দামও বাড়াতে হয়। এই গরিবের দেশে টিকিটের দাম দু’ টাকা বাড়ালেও বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না শুনতে পাই।
রাস্তাঘাটের কথা আর কী বলার আছে! ক’দিন আগেই কলকাতা শহর ভারী বর্ষণে জলজমাট। ইস্টার্ন বাইপাস নামে সড়কটি আগে লোকের ভরসাপথ ছিল। একটু ঘোরা হলেও দ্রুত যাওয়া যায়। সে পথেও এখন প্রাণ ওষ্ঠাগত করা খানাখন্দ এবং যানবাহুল্যে জটিল। দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও যেমন উদ্যোগ নেই, পরিবেশের কথা ভেবে যানসংখ্যা নিয়ন্ত্রণও অকল্পিত। অথচ রাস্তাঘাট মসৃণ রেখে, কিছু সুসভ্য বাস যদি বিভিন্ন পথে চালু করা যায়, যদি সাইকেলপথ গড়ে দেওয়া যায়, অনেকেই সে সব ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারেন। কিন্তু হয় উল্টোটাই। এক রকম বাস ছিল, তাতে আসন ভরে গেলে আর যাত্রী নেওয়ার নিয়ম ছিল না। ভাড়া, স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেশি। সে বাস উঠে গেল। যাত্রী মেলে না বলে নয়। দাঁড়িয়ে যাওয়া যাবে না এমন নিয়ম ভঙ্গ করার আমজনতাসুলভ প্রবণতায়। যেন, দাঁড়িয়ে যাওয়াও এক ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার, তাতে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিষেবা আয়োজিত ছিল, লোকে নিল না। নেওয়ার মনটাই তৈরি হয়নি। আমাদের গরিবিমুখী রাজনীতির বহু খারাপ দিকের এটাও এক রকম। ভাড়া না বাড়ানো, ট্যাক্স না নেওয়া, ভরতুকি, বিনা মূল্যে খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা জল বিতরণ এ সবের ফলে এক রকম আলস্য এবং অযত্নের সংস্কৃতি তৈরি হয়। দারিদ্রের সঙ্গে আত্মসম্মানবোধ এবং রুচিসম্পন্নতার যে কোনও বিরোধ নেই, তা বোঝানো অত্যন্ত জরুরি। এ নিয়ে এক রসিক গল্প চালু আছে। এক ব্যক্তি কোনও বাসের মহিলা আসনে বসে আছে। মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে দেখেও সে ওঠে না। উঠছ না কেন, তার জবাবে সে বলে, কেয়া করেগা বাবু, গরিব আদমি হ্যায়।
দরিদ্রের সংখ্যা বেশি, তাই ভোটদাতা হিসেবে তাদের গরিব ও অসচেতন করে রাখার সুবিধা মেলে হাতে হাতে। কিন্তু তা ন্যায়নিষ্ঠ কাজ নয়। বরং গরিবপনা যে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায় তা সমাজের সব স্তরে ছেয়ে যেতে থাকে।
অটোকে নীল থেকে সবুজে পরিণত করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কিন্তু অটোচালকগণের দুর্ব্যবহার এবং সামনের আসনে এক জনের পরিবর্তে চার জন যাত্রী নিয়ে বিপন্নপ্রাণ আসাযাওয়া তো থামল না! শহরের একটি মূল রাস্তায় প্রত্যহ দেখি, ক্রসিংয়ে গাড়ির সারি জমলে অটো-রাজের দৌরাত্ম্য। তর সয় না। প্রবল গতিতে বিভাজনরেখা টপকে আসার পথকে তারা যাবার পথ করে নেয়। সার্জেন্ট থাকলে একটু রয়ে-সয়ে, না থাকলে সাধারণ ট্র্যাফিক পুলিশকে পাত্তাই দেয় না। আগেও দিত না যেমন। একই মানসিকতায়, নির্ধারিত সময়ের আগেই শহরের রাস্তায় ঢুকে পড়ে কিছু ট্রাক এবং ধরা পড়তে পারে এই ভয়ে উন্মাদের মতো চলে। ভয় হয়, কবে ধাক্কা খাব, মরে যাব কিংবা হাত-পা ভেঙে হাসপাতাল!
সেখানেও ঠাঁই জুটবে কি? নতুন মুখ্যমন্ত্রী, সিংহাসনে বসেই হাসপাতালগুলির ঝুঁটি ধরে যে নাড়াটি দিলেন, যেভাবে নির্দেশ জারি করলেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে কোনও রোগীকে ফেরানো যাবে না, খুব ভরসা হল। এর ক’দিন পরেই এক নিকটাত্মীয়া হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তাঁকে দেখতে আর জি করের জরুরি বিভাগে (মহিলা) গেলাম। গায়ে গায়ে একফালি করে শয্যা। পাতলা নোংরা তোষক বালিশ। নোংরা মেঝে। আধা উলঙ্গ রোগিণী। পূতিগন্ধে দম আটকে আসে। হাহাকার, আর্তনাদ, গোঙানিরত রোগিণীদের ঘিরে আছে ‘বাড়ির লোক’, অগুনতি। আর তাদের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে মেঝেয় রোগী শুয়ে আছে। সারা পথ মাড়ানো নোংরা জুতো থেকে শয্যাশায়ী রোগিণীর থুথু-প্রস্রাব ফেলার পাত্র তাদের মাথার কাছে। এক যুবক চিকিৎসক ছিলেন আমার চেনা। তাঁর হতাশায় আমার ভয় করল। জরুরি বিভাগে এক জন নার্সের দায়িত্বে থাকে কমপক্ষে দশ জন রোগী। অধিকপক্ষে কত, তার ঠিক ঠিক অঙ্ক নেই। পেটে জল নিয়ে অনেক রোগী আসেন, যাঁর চিকিৎসার একটি প্রয়োজনীয় পদ্ধতি নল দিয়ে পেট থেকে জল বের করা। শয্যায় ঠাঁই না পেলে মেঝেয় শায়িত রোগীর ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতি একটি দেখনদারি প্রয়োগ হয়ে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী জল বইয়ে দেবার জন্য উচ্চতার তারতম্য লাগে। তা না থাকায়, অর্থাৎ শয্যার অভাবে, রোগী মৃত্যুর দিকে চলে যায়। তা হলে দাঁড়াল কী? রোগীর ঠাঁই হল হাসপাতালে, চিকিৎসাও পেল, আসলে কিন্তু পেল না। ঠাঁই না পেলে, বেসরকারি ব্যয়সাধ্য হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও সে মরত। এখানেও মরল। তা হলে এটা অন্তত বোঝা গেল, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি মানে শুধু রোগী না ফেরানো নয়। সমগ্র পরিকাঠামোর বদল। মানসিকতার পরিবর্তন। যে পরিবর্তন হাসপাতাল থেকে পুলিশ প্রশাসন কোথাও উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল না এখনও।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাদু তৎপরতায় সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, এমন আশা বাতুলতা। কিন্তু প্রশংসনীয় উদ্যোগ অল্প দিনেই প্রশ্নচিহ্ন সমেত স্তিমিত হয়ে এলে ‘ভরসাফুর্তি’ উৎসবের সন্দেহ দেখা দেয়। হাসপাতালগুলিতে আজও পূর্বানুরূপ অবস্থা। বিরাট ঢাক পিটিয়ে করা গোর্খাল্যান্ড চুক্তির পরেও দার্জিলিঙে গোর্খাল্যান্ডের নামে ঠিকানা ঝোলে, পশ্চিমবঙ্গ নয়। জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরেনি। সমস্যা মেটেনি। খবরের সরবরাহও আগের চেয়ে কম। গ্রামাঞ্চলে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলছে। সি পি এমের বিশ্বাসযোগ্যতা এতটাই কমে গেছে যে তাদের চিৎকারে আর কেউ কান দেয় না। কিন্তু কেশপুরের পিউ রায় বা খানাকুলের অপমানিত নির্যাতিত মহিলার আর্তনাদে কর্ণপাত না করে পারা যায় কি? পুলিশের বহু নিরুদ্যমের একটি এখন ঘটছে সামনেই। এক প্রতিবেশীর অ্যালঝাইমার আক্রান্ত পিতা হারিয়ে গেছেন সম্প্রতি। স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে সি আই ডি নিরুদ্দেশ দফতর সর্বত্র ঘটনাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে। প্রায় এক মাস কেটে গেছে, কোনও বিজ্ঞাপন, কোনও ঘোষণা নেই সরকারি তরফে। এই সময়ের মধ্যে বৃদ্ধ মানুষটির কত কিছু হতে পারে, ভাবলে বিষাদ এবং অসহায়তা আক্রমণ করে। এর পরিণতি সর্বগ্রাসী। কিছুতেই ভাল থাকা যায় না যেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.