দিগন্তের পাহাড় সাক্ষী,
সেই মাতাল গন্ধ আর নেই পশ্চিমে

মি মশাই সৌমিত্রকে দেখেছি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পাথরের উপর বসে আছেন। উদাস। দূরে নীল পাহাড়। শুভেন্দুকেও দেখেছি। আধময়লা পাঞ্জাবি গায়ে। বললেন অনাথবন্ধু।
আমিও পুজোয় হেমন্ত মুখুজ্জেকে দেখেছি। শতরঞ্চি বিছিয়ে গাইছেন, ‘আমার সকল রসের ধারা।’ বললেন কল্পনা।
আর আমি? আমি কাকে দেখেছি জানেন? ন্যাপাকে।
ন্যাপা?
হ্যাঁ ন্যাপা। যে সে লোক নন মশাই। মহানায়ক উত্তমকুমারের ড্রাইভার। এই যে ঘোষ টেলারিং দেখছেন, মধুপুরের সবাই চেনে। তা হবে ধরুন, ৫৮-৫৯ সাল। এখানে বসে আছি। হঠাৎ একটা লম্বা কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল। ন্যাপাবাবু বললেন, ‘বাঙালির দোকান? ভালই হল। পেট্রোল কোথায় মিলবে জানেন?’ দিলাম পথ বাতলে।
কী করে বুঝলেন উনি উত্তমকুমারের ড্রাইভার? আর ওঁর নাম ন্যাপা।
এখনই শুনবেন? নাকি আগে দুটো রসগোল্লা খাবেন! খেয়ে নিন, খেয়ে নিন। উত্তমকুমারের সঙ্গে এই অধম হেঁটেছেও। একটু ঘুরে আসুন। সব বলব। বললেন হারুরঞ্জন।
অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়, হারুরঞ্জন ঘোষ ও কল্পনা ঘোষ মধুপুরের বাঙালি। বাঙালি বলেই দু-চারটে কথার পরে খলবলিয়ে উঠেছে স্মৃতির ঝাঁপি। মধুপুর, শিমুলতলা, গিরিডি, দেওঘর নিয়ে যে বাঙালির সাধের ‘পশ্চিম’ তার ছালবাকল উঠে পড়েছে। ওঁরা ডুব দিয়েছেন শিরীষ, মহুল আর ইউক্যালিপটাসের গন্ধ মাখা সেই স্নিগ্ধ উচ্ছ্বাসের দিনগুলিতে।
অনাথবন্ধু প্রাক্তন অধ্যাপক। সাহিত্যসেবী ও সজ্জন। মধুপুরের প্রায় সবাই এক ডাকে চেনে। চমৎকার আবৃত্তি করেন। গলাটা খাদে নামিয়ে শুরু করলেন,
নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে
মহিষ চরছে হরুতুকি গাছের তলায়
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপর...।
সঙ্গী ছিল না কেউ
কেবল ছিল সেই ক্যামেলিয়া।

রবীন্দ্রনাথের ‘ক্যামেলিয়া’। সাঁওতাল পরগনার নিখুঁত ছবি। চলুন একটু হাঁটি।
টাঙ্গায় যাবেন?
টাঙ্গায়? টাঙ্গা এখন খুব বেশি চলে না। হাঁটতে হাঁটতে বাড়িগুলির নাম দেখবেন। ‘একান্তে’, ‘নিরিবিলি’, ‘পথের ধারে’, ‘একলা পথে’। সবই রোমান্টিক। আলস্যে ভরা। বাঙালি তো! এখানে প্রায় সব বাড়িই পশ্চিমমুখো। পশ্চিমের হাওয়া মানে হিমালয়ের হাওয়া। খনার বচন এখানে খাটবে নাপশ্চিমদুয়ারির মুখে ছাই। ও হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের কথা যখন উঠলই তখন বলি, কবির হোমিওপ্যাথির বইটা সম্ভবত মধুপুর স্টেশনেই হারিয়েছিল।
হোমিও হিমুও তো ছিল গিরিডিতে। সুবোধ ঘোষের ‘শুন বরনারী।!’
হ্যাঁ, হ্যাঁ ছিল। পশ্চিমে তো লেখকের অভাব নেই। সুবোধ ঘোষ, বিমল কর, বনফুল, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্রও ছিলেন দেওঘরে। রেলের কুলি ছাড়া সবাই বাঙালি। ডাক্তার, উকিল, রেলকর্মী...। পেটরোগা বাঙালি পশ্চিমের ইঁদারার জল খেতে আসত। অনেকে থেকেই যেত। পাকাপাকি।
কিছুটা হেঁটে থামলেন অনাথবন্ধু। এই যে জায়গাটা দেখছেন, এখানে ছিল স্যার আশুতোষের বাড়ি। ‘গঙ্গাপ্রসাদ হাউস’।
এটা তো রোমান্টিক নাম নয়।
স্যার আশুতোষ তো রোমান্টিক ছিলেন না। কাজের মানুষ। ঠাকুরদার নামে বাড়িটি তৈরি করেন। আসল বাড়িটা এখন নেই। আমি ছিলাম স্যার আশুতোষের ছেলে উমাপ্রসাদের চেলা। বিয়াল্লিশটা আমগাছ ছিল। কাঁঠাল, পেয়ারা, আতাও প্রচুর। একদিন উমাপ্রসাদের কাছে বসে আছি। এক দম্পতি এলেন। বললেন, ‘এটা কি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ বাড়িটা আগাগোড়া দেখে মহিলা বললেন, ‘ওগো দেখেছো, লিখে কত বড় বাড়ি করা যায়!’ আমরা তো হেসে অস্থির। উনি লেখক আশুতোষ আর স্যার আশুতোষকে গুলিয়ে ফেলেছেন।
অনাথবাবু হাঁটতে থাকেন। রিকশার প্যাঁক প্যাঁক, মোটরবাইকের হর্ন। বললেন, “এক সময় নিজের জুতোর আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যেত না। এতটাই নির্জন। শিরীষ ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগত। আর ছিল ইউক্যালিপটাসের হাওয়া। রাস্তার ধারে, বাড়ির পাঁচিলের সামনে ছিল প্রচুর ইউক্যালিপটাস। উমাপ্রসাদ বলতেন, ‘সঙ্গিন-কাঁধে প্রহরীর মতো।’ সেই গাছগুলো কোথায়? সেই মাতাল গন্ধ! কিছুই আগের মতো নেই। কত বাঙালি যে পাততাড়ি গুটিয়েছে!”
দুর্গাপুজো হয় না এখন?
হয়। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে বড় পুজো হয়। পুজোয় কে না আসত মশাই। সৌমিত্র, শুভেন্দু, বিকাশ রায়, পাহাড়ি সান্যাল, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। অতুল্য ঘোষকেও কালো চশমা পরে হাঁটতে দেখেছি। মন্দিরের সামনে নীল সামিয়ানার নীচে মুকুন্দদাসের যাত্রা হত। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় গাইতেন কীর্তন। এখন তো পুজোয় অর্কেস্ট্রা বাজে।
মন্দিরের পাশেই বলাইবাবু রোডে জিতেন্দ্রনাথ লাইব্রেরি। নামেই লাইব্রেরি। একটা বইও নেই। ফাঁকা ঘরে একটা ভাঙা ক্যারাম বোর্ড, একটা ভাঙা চৌকি ও কয়েকটা রঙের বাক্স।
বই নেই কেন?
অনাথবাবু বলেন, “কে বই পড়বে মশাই! বাঙালি এখন বই পড়ে না। মধুপুর কলেজে বাংলা বিভাগটাই বোধহয় উঠে গেছে।” পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। একটি স্কুল চালান। বললেন, “আমরা এখন ‘হচ্ছি’ বাঙালি। উনি আমার মা হচ্ছেন, উনি আমার ভাই হচ্ছেন, এসব আর কী! তবে এখনও পুজোয় বলি হয়। তিনটে আখ, একটা চালকুমড়ো।
মন্দির পেরিয়ে খানিকটা দূরে লক্ষ্মীবিলাস তেলের মালিকের বাড়ি। অনাথবাবু বলেন, “এই কারখানার ম্যানেজার ছিলেন শক্তি সেনগুপ্ত। দারুণ সেতার বাজাতেন। ওঁর চার মেয়েই গান করত। এক মেয়ে ছিল ‘শাপমোচন’-এর কমলিকা। পুজোয় জমজমাট অনুষ্ঠান। এক বার শ্যামা তো এক বার চিত্রাঙ্গদা।
এ তো শিমুলতলার ‘দাদার কীর্তি’।
তা যা বলেছেন। দারুণ ছবি বানিয়ে ছিলেন তরুণ মজুমদার। তবে ছন্দবাণী ক্লাব এখন আর নেই। ওই ছন্দটা মনে আছে?
কে যায় হোথায়
সন্দীপ রায়
এত তাড়াতাড়ি ছুটছিস কেন?
পুরুতমশাই আসেনি এখনও
অ্যাঁ, সেকি!
যাই, দেখি।

ছন্দ মিলিয়ে কথা বলার জন্য একটা ক্লাব। ভাবা যায়! কী ছিল পশ্চিমের বাঙালি!
কথা বলতে বলতে ফের সেই ঘোষ টেলারিং। মানে সেই হারুরুঞ্জন ঘোষ। বললেন, “শুনবেন নাকি বাকিটা? তা হলে শুনুন। আমরা জানতাম উত্তমকুমার এসেছেন। কালো গাড়িটাও তাঁরই। ন্যাপা নামটা পরে জেনেছি।” কল্পনাদেবী বলেন, “ওটা বল।’’ কোনটা? আরে উত্তমকুমারের জল খাওয়া। হারুবাবু শুরু করেন, “আমরা তো ওঁর বাড়ির সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতাম। দুপুরে শুধু বাড়িতে খেতে আসতাম। একদিন উনি বললেন, ‘আমি একটু হাঁটব। তোমরা যাবে আমার সঙ্গে?’ আমি বললাম, আপনি হাঁটবেন! একটা মেয়েও তো ঘরে থাকবে না। তা উনি হাঁটা শুরু করলেন। কিছুটা গিয়েই বললেন, ‘তেষ্টা পেয়েছে। পাশের বাড়ি থেকে একটু জল আনবে? তবে খবরদার, আমার নাম বলবে না।’ কাঁসার গেলাসে জল এল। উনি খেলেন। মুখটা মুছে হেসে বললেন, ‘এ বাড়ির লোক খুব মাছ খায়। গেলাসে মাছের গন্ধ।’
হারুবাবুর ঘরেও সবাই হো হো হেসে উঠলেন। নীল পাহাড়, ইঁদারার জল, মিঠে হাওয়া সেই হাসির সঙ্গে তিরতির করে কেঁপে উঠল।
কাঁসার গেলাসে বাঙালির সেই গন্ধটা যেন আবার হাজির ঘোষ টেলারিংয়ে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.