বঞ্চনা নামিয়েছিল মিছিলে,
এখন বলতে চান না অনেকেই
থায় শুধুই হতাশা। মাজুগেড়া গ্রামের প্রৌঢ়া ফুলমণি সর্দার বলেছিলেন, “মিছিলে গেলেও পিটুনি, না গেলেও পিটুনি।” তাঁর ছেলে ভরত সর্দারকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল, মাওবাদী সন্দেহে।
আর কাঁকড়াঝোরের নবনীতি মাহাতো বলেছিলেন, “লোকে কিছুটা ভয়ে মিছিলে গিয়েছে। গ্রামের সবাই যাচ্ছে। ৫০০০ লোকের মিছিল, তার মধ্যে এক হাজার মহিলা। আপনি না গেলে তো এক ঘরে হয়ে থাকবেন।” কাঁড়বাঁশ (তির ধনুক) নিয়ে তিনিও তাই গিয়েছিলেন।
কিন্তু শুধুই ভয়েই কি মহিলারা মিছিলে গিয়েছিলেন? অনাহারের আমলাশোলে যিনি মন্ত্রীর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, গ্রামে ডাকাবুকো বলেই যিনি পরিচিত, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী সেই নবনীতির ভয়! প্রশ্ন করলে নবনীতি প্রথমে উত্তর দেন না। বাইরে চারদিক সাদা হয়ে বৃষ্টি নেমেছে। দূরে পাহাড় মিলিয়ে গিয়েছে মেঘের আড়ালে। সেই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এক সময় বলেন, “অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ না করে থাকতে পারি না। অন্যায় দেখলে আবার বলব।” তাঁর বাড়ির পিছনেই সিআরপিএফ-এর শিবির। কাছেই সেই ট্যুরিস্ট বাংলো, যা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা।
কী অন্যায়ের কথা বলতে চেয়েছিলেন তিনি? কোথাও তা অনুন্নয়ন, কোথাও তা রাজনৈতিক অত্যাচার, কোথাও তা পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর অত্যাচার। বেলপাহাড়ি, নয়াগ্রাম এলাকায় যাঁর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মেয়েদের নিয়েই কাজ করছে বছর ছ’য়েক ধরে, সেই স্বাতী দত্ত বলছিলেন সে কথা। তাঁর বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠীর আদিবাসী মেয়েদের তিনি দেখেছেন মিছিলে যেতে। নেতৃত্বে আদিবাসী সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি মাডওয়া’। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ে হামলার পরে পুলিশের অভিযানে চোখ নষ্ট হয়েছিল ছিত্যামণি মুর্মুর। উঠেছিল বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের অভিযোগ। স্বাতীদেবীর বক্তব্য, সেই অত্যাচারকে সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হলেও তাতে জুড়ে গিয়েছিল বহু দিনের জমে ওঠা ক্ষোভ। “আমার মেয়েদের যখন প্রশ্ন করতাম, ওরা বলত, বহু দিন আমাদের দাবিয়ে রেখেছে। কিছু দেয়নি। তাই আমরা পথে নেমেছি।”
এই পথে নামার পিছনে নেতৃত্বের চাপ বা ভয় দেখানোর ঘটনা-ও ছিল ঠিকই। তবে বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, ভুলাভেদা, কাঁকড়াঝোড়ের ‘অগম্য’ এলাকায় যাঁর নামে দরজা খুলে যায়, জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি সেই সুব্রত ভট্টাচার্যও প্রথমেই বলেন, “আমরা মূল স্রোতের দলগুলো এঁদের সমস্যা সমাধান করতে পারিনি। মাওবাদী বা কমিটি সেই রাজনৈতিক ফাঁকটা পূরণ করেছিল। মানুষ ভেবেছে, এরাই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তাই আন্দোলনে নেমেছিল।”
কিন্তু পরবর্তী কালে মিছিলে মহিলাদের মুখগুলো কমে যেতে থাকে। ধরপাকড় যদি একটা কারণ হয়, আর একটি কারণ আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব। মাঝি মাডওয়ার নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ বাধে কমিটির। দ্বন্দ্ব কমিটির নেতৃত্বের মধ্যেও বেধেছিল। ‘খুনের রাজনীতি’ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকেন আদিবাসী মহিলাদের একাংশ। তাই আজ সেই আন্দোলনের কথা জিজ্ঞেস করলে মুখ খুলতে চান না অনেকেই।
ছোটপেলিয়া গ্রামে ছিত্যামণির বাড়ি গেলে দরজা আটকে থাকেন তাঁর যুবক ছেলে। “মা তো বাড়ি নেই। কুটুম বাড়ি গিয়েছে।” কুটুম বাড়ি কোথায়? উত্তর নেই। তাঁর বাড়ি ছাড়িয়ে রামগড় জোড়া ব্রিজের কাছে চৌকিশাল। বাসস্ট্যান্ডে দেখা যে সব আদিবাসী মহিলার সঙ্গে, নাম তো বলেনই না, আন্দোলনের কথা তুললে বলেন, “জানি না। কাজকাম করে খাই।” বিনপুরের দহিজুড়ির রঘুনাথপুর গ্রামের কাজল সরেনও মুচকি হাসেন। বলেন, ঝাড়গ্রামে আসেন কাজ করতে। সকালে বেরোন, সন্ধ্যায় ফেরেন, মাঝখানে গ্রামে কবে কী হয়েছে, কী হয়, জানবেন কী করে? যে বাঁশতলায় রাজধানী এক্সপ্রেস আটকে দিয়েছিল মাওবাদীরা, সেই গ্রামের ঠাকুরমণি মান্ডি, কাজল মুর্মুরা এখন শুধু বলেন, “আমরা শান্তি চাই।”
এই শান্তি কে দেবে? নতুন সরকার না ফের নতুন আন্দোলন? ধরমপুরে অনুজ পাণ্ডের ভাঙা বাড়ির পাশে বসে তাঁরই তুতো দাদা, তৃণমূলের সমর্থক বিমল পান্ডে বলেন, “একমাত্র সরকারই উন্নয়ন, শান্তি দিতে পারে। সাধারণ মানুষের আন্দোলনের একটা লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। রাজনৈতিক অত্যাচারের একটা পর্ব শেষ হয়েছে। এখন উন্নয়নের সময়।” তাঁর দাবি, এখন তাই মাওবাদী বা কমিটি নয়, লোকে সরকারের দিকেই তাকিয়ে।
কিন্তু বিমলবাবু যা বলছেন, তা পুরোপুরি মানছেন না লক্ষ্মীমণিযৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত লালমোহন টুডুর স্ত্রী। সম্প্রতি এক সমাবেশে স্বামীর মৃত্যুর উল্লেখ করে বিচার চেয়েছেন তিনি। চেয়েছেন যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার। লক্ষ্মীমণি ভোট দিয়েছিলেন তৃণমূলকে। আশা ছিল, নতুন সরকার লালমোহনের মৃত্যুর তদন্ত করবে। লালমোহনের মা-ও বলেন, “নতুন সরকার নেতাই কাণ্ডের তদন্ত করাল, নিজের দলকে যা দিবার দিল। আমাদের জন্য কিছুই করল না।”
আর এই ক্ষোভকে সামনে রেখেই মহিলাদের নিয়ে নতুন চেহারায় আন্দোলন শুরু হচ্ছে জঙ্গলমহলে। যে আন্দোলনের মুখ জ্যোৎস্না মাহাতোরা।

(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.