নতুন জুতোর বদলে ফুলের সাজ, ঘুঙুর! হাল-ফ্যাশনের শার্ট নয়, বাহারি কলকা তথা ময়ূরের পালক। পুজোর সাজ এ ভাবেই পাল্টে গিয়েছে। ট্রেনে মাত্র তিন ঘণ্টার দূরত্বে কলকাতার কথা ছেড়ে দিন, মাত্র ৪২ কিলোমিটার দূরের ইস্পাত-নগরী জামশেদপুর বা কাছেই খড়্গপুর টাউনও এমন ধরাচুড়ো দেখলে হেসে কুটিপাটি হবে। কিন্তু এই নীল-সবুজ বন-পাহাড়ের দেশের কথা আলাদা। ষষ্ঠী পড়তে না-পড়তে এ সব সাজসজ্জা যথারীতি তকতকে পালিশে চকচকে হয়ে উঠবে।
কোনও মণ্ডপের সাজানো থিম নয়। ঘাটশিলার কাছে-পিঠে গ্রামে গ্রামে সাঁওতাল-মহল্লায় এটাই দস্তুর। বাঁশের মণ্ডপে পাঁচ ছেলেমেয়ে-সহ মা দুগ্গা, মহিষাসুর, বাহনকুলের এখানেও দেখা মিলবে। কিন্তু বোধনের লগ্ন এক অন্য ছন্দে রক্তে দোলা দিয়ে যায়। হেন্দলজুড়ি গ্রামে ভুয়াং বেজে উঠতেই নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে বাইজন মুর্মু অস্ফুটে বলেন, “জোয়ান বয়সে এই দাশাই নাচ তো আমিও নাচতাম বটে!” শুনে পাশে বসা বুড়ি বৌ, চম্পা স্বামীকে ঠাট্টা করেন, “এই বুড়াটা নাচবে দাশাই নাচ, তাহলেই হয়েছে!” |
ঘাটশিলার হেন্দলজুড়ি গ্রামে চলছে দাশাই নাচের মহড়া। ছবি: অর্জুন সিংহ |
ভুয়াং মানে লাউ-চালকুমড়োর শুকনো খোল। ভিতরটা ফাঁপা। পিঠে ধনুক বাঁধা। ছিলায় টান পড়তেই লাউ ঘটঘটিয়ে গ্রামের আকাশ-বাতাস ছন্দে ভরে যায়। ষষ্ঠী থেকে দশমীঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালদের গ্রামে গ্রামে এই ভুয়াং বাজিয়ে দাশাই নাচ এক সময় ধর্মাচরণেরই অঙ্গ ছিল। এখনও চলছে, তবে টিমটিমে। ঘাটশিলার প্রবীণ বাসিন্দা, সরকারি কর্মচারী গৌরীশঙ্কর দত্তদের মতো কারও স্মৃতিতে, টাউনেও পুজো-মণ্ডপে দাশাই-এর আসর বসত। কাশিদার পুরনো পুজোয় গ্রাম থেকে সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষের দল আসত। তবে নাচত শুধু ছেলেরা।
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঁওতালি ভাষার বিভাগীয় প্রধান, কৃষ্ণচন্দ্র টুডু শুনিয়েছিলেন, এই দাশাই হল দুই বোন, আয়ন আর কাজলকে খোঁজার
নাচ-গান। লোকগাথা অনুযায়ী, দু’বোনকে বাইরের লোকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে গোটা সাঁওতাল-সমাজ তাদের জন্য হন্যে হয়ে ওঠে। জোয়ানরা বয়স্কদের কাছে পরামর্শ নিয়ে দিকে দিকে নাচে-গানে যোগ দেয়। সাঁওতালদের গুরু-শিষ্য পরম্পরারও না কি দাশাই থেকেই শুরু। চুড়ি-শাড়ি-পরচুলা-শিখিপাখায় মেয়েদের মতো সেজে পুরুষরা আখড়ায় নামে। ভুয়াং বেজে ওঠে॥ তিনিই বললেন, “আগে ঘাটশিলা ব্লক ও আশপাশের আমডোঙা, ঘিকুলি, কালাজর, সর্দারগোড়া গ্রামের নাচের টিম নামত। কোনও আখড়ায় নাচের প্রতিযোগিতা। পাঁচ দিন ধরে গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘুরে নাচ দেখিয়ে ছেলেরা চাল-পয়সা কাপড়ে বেঁধে ফিরত।” শিল্পীর আফশোস, “সেই নাচের টিম বা রনক (জৌলুস) আজ নাই। নতুন ছেলে, সামানেরও (সাজগোজের সরঞ্জাম) অভাব। তবু পুজোয় একটু না-নেচে পারি না।” ক্বচিৎ-কদাচিৎ কোনও লোকশিল্পী কলকাতার মণ্ডপেও থিম-এর
দরকারে ডাক পান। তাতে জীবন অবশ্য বিশেষ পাল্টায় না।
হেন্দলজুড়ির চম্পাদেবীর স্বামী, মৌভাণ্ডারের এইচসিএল-এর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বাইজন মুর্মুও এক কালে দাশাই-এর আসর মাতাতেন। জোয়ানদের নাচের সাজের শিখিপাখা, কাগজের ফুল বা বাহা তিনি ঘর থেকে বের করে নিয়ে এলেন। চম্পাদেবী বলে ওঠেন, “এই বাহা-কলকা বুড়াটার বটে। ঘাটশিলায় রংকিনী মায়ের বিঁধা মেলা থেকে কেনা। এই বুড়াটা তখন জোয়ান ছিল বটেক!”
সেরেঞ শুরু হয়।
“দেনতি আওগো আওগো, শিলি চওঁরি টেইড়ি হাপা
দেনতি নায়োগো নায়োগো, আরশি নাকি বাহা বাঙ্গুরায়।”
উৎসবের দিনে গানে-গানে দেবীর কাছে নাচের সাজ, পরচুলা, ঘুঙুরের জন্য প্রার্থনা করেন গাঁয়ের শিল্পীরা। পুজোয় নতুন জামার চিরকেলে আকুতিই যেন সেই সুরে মিশে। |