প্রতিবারই পুজোর ময়দানে শিল্পীদের নিয়ে উদ্যোক্তাদের কাড়াকাড়ির ছবিটা পরিচিত। কিন্তু প্রতি পুজোতেই দেখা যায়, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের পাশাপাশি উঠে আসেন নতুন কোনও তারকা। পরের বছর আবার তাঁকে নিয়েই পড়ে যায় কাড়াকাড়ি। এ বারের পুজোও অবশ্য তার ব্যতিক্রম নয়। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, নতুনদের কাজ ইতিমধ্যেই নজর কাড়তে শুরু করেছে।
গত কয়েক বছর মোটামুটি ভিড় হয়েছিল ‘সিঁথি ইউথ অ্যাথলেটিক’-এর পুজোয়। এ বার সেখানে পঞ্চমী থেকেই দর্শনার্থীর ঢল। কর্নাটকের এক ভগ্নপ্রায় দুর্গামন্দিরকেই এই পুজোর থিম হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিল্পী সৌরভ দত্ত। পুজো কমিটির কর্তারা জানান, কর্নাটকের বিজয়নগরে এই মন্দিরের সন্ধান পেয়েছিলেন তাঁরা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। উদ্যোক্তাদের দাবি, সেই ধ্বংসাবশেষের রূপকেই পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে মণ্ডপে। নবীন শিল্পী হলেও সৌরভের কাজ দেখে অবশ্য তা বোঝার উপায় নেই। আর প্রতিমা-শিল্পী গৌতম ধর এই পুজোয় তিরুপতির আদলে তৈরি করেছেন দেবীর মূর্তি। সালঙ্কারা সোনালি রঙের মূর্তিও নজর কাড়ছে দর্শকদের। নিখুঁত কাজ আর ষষ্ঠীর সন্ধ্যাতেই সিঁথি ইউথের মণ্ডপের সামনে লম্বা লাইন দেখে ধরে নেওয়া হচ্ছে, পুজোর বাজারে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে চলেছেন সৌরভ।
প্রতিযোগিতায় উঠে এসেছেন আরও কয়েক জন। যেমন, শিল্পী মানস রায়। হাটখোলা গোঁসাইপাড়ার মণ্ডপে তিনি তুলে ধরেছেন সাধারণ নারীকে। যে নারী রোজকার হাজারো অত্যাচার সয়ে বেঁচে থাকে। মণ্ডপের বাইরে ক্রীড়া ও বিজ্ঞানে নারীদের কৃতিত্ব আর ভিতরে কন্যাভ্রূণ হত্যা-সহ অত্যাচারিত নারীদের জীবনগাথা। মণ্ডপসজ্জার উপকরণ শোলা। প্রতিমাশিল্পী কুমোরটুলির স্বপন পালের হাতে গড়া দেবী আর পাঁচটা বাঙালি নারীর মতোই।
নবীন শিল্পীকে নিয়ে কাজ করেছে গড়িয়া কেন্দুয়া শান্তি সঙ্ঘও। সেখানে শিল্পী প্রদীপ মণ্ডলের হাতে ফুটে উঠেছে সুন্দরবন। থিমের ভাষায়, ‘ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো’। ক্লাবের মাঠ প্রায় সাড়ে তিন ফুট কেটে তৈরি হয়েছে সুন্দরবনের নদী। পুজো কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি মানব দত্ত জানান, নৌকা গড়তে সুন্দরবন থেকেই কারিগর নিয়ে আসা হয়েছে। নৌকার উপরেই তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। নজর কাড়ছে জীবন ভাস্করের প্রতিমাও।
দুর্গা শুধু অসুরবিনাশিনী নন, তিনিও আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো ঘরকন্না করেন, সন্তান পালন করেন। বেহালা সবেদাবাগানের পুজোয় এই ভাবনাকেই রূপ দিয়েছেন শিল্পী তরুণ বেরা। তার সঙ্গে মানানসই প্রতিমা তৈরি করেছেন রামনারায়ণ রায়। দর্শনার্থীদের বক্তব্য অনুযায়ী, বাঁশ, মাটি ও প্যাকিং বাক্স কেটে বানানো খুন্তি, বঁটি, বেলনচাকি, হাঁড়ি, কড়াই দিয়ে তৈরি অভিনব মণ্ডপ আর প্রতিমা নজর কেড়েছে দু’টোই।
শিল্পী শক্তি শর্মা অবশ্য থিমের জটিল তত্ত্বে ঢোকেননি। তিনি নাকতলা ভ্রাতৃমিলনের মণ্ডপ সাজিয়েছেন ঘণ্টা ও কড়ির মতো পুজোর উপকরণ দিয়েই। সঙ্গে রয়েছে টিনের কৌটো। শক্তিরই তৈরি দেবীমূর্তি এখানে অভয়দাত্রী। ‘অ্যাভিনিউ সাউথ পল্লিমঙ্গল সমিতি’র শিল্পী শুভাশিস চক্রবর্তী আবার এই পুজোয় থিম হিসেবে বেছেছেন পিঁড়িকে। ফেলে আসা বঙ্গজীবনের নস্টালজিয়া পিঁড়িকে থিম হিসেবে তুলে ধরে স্মৃতিকেই একটু উস্কে দিতে চেয়েছেন তিনি।
নামী পুজোর পাশে অপেক্ষাকৃত নতুন শিল্পীদের কল্পনাপ্রসূত এই পুজোগুলো ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে দর্শনার্থীদের। পঞ্চমী আর ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় মণ্ডপের বাইরে লম্বা লাইনই ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামী দিনে পুজোর লড়াইয়ে তারকা হয়ে উঠবেন এঁরাই। |