এদের কোনও থিমের প্রয়োজন হয় না। সাবেকিয়ানার উজ্জ্বল আলোতেই এরা ঝলমলে।
শহরের পুজোয় বেশ কয়েক বছর ধরেই নানা থিমের ছড়াছড়ি। দিন দিন বাড়ছে সেই থিমের বৈচিত্র ও জৌলুস। কিন্তু এই শহরেই এমন কয়েকটি পুজো রয়েছে, যেখানে ঐতিহ্যই বড় কথা। সেই টানেই প্রতি বছর মানুষের ঢল নামে সেই সব মণ্ডপে। কোথাও দর্শনার্থীরা যান সাবেক আবহের টানে, কোনও পুজোমণ্ডপ আবার হয়ে ওঠে এক মিলন ক্ষেত্র।
সাবেক পুজো বলতে প্রথমেই উঠে আসে উত্তরের বাগবাজার সর্বজনীনের নাম। দীর্ঘ দিন ধরে একই ধরনের একচালার প্রতিমা। প্রতিমার রং, চোখ বা আকারে কোনও পরিবর্তন হয়নি এই পুজোয়। সেই টানেই বাগবাজারের মণ্ডপে ভিড় জমাতে দেখা যায় আট থেকে আশিদের।
কাশীপুর অঞ্চলের বাসিন্দা অজয় সেন বলেন, “ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বাগবাজারের মণ্ডপে যেতাম। তখন অবশ্য এত রোশনাই ছিল না। কিন্তু এখন সময় বদলালেও সেই পুজোর আমেজের কোনও বদল হয়নি।” আর এই অপরিবর্তনই বাগবাজারের ‘ইউএসপি’ বলে মনে করেন ম্যানেজমেন্ট চাকুরে, বছর ছাব্বিশের প্রদীপ দে। বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ চষে ফেললেও এক বার বাগবাজারের মণ্ডপে অবশ্যই যাওয়া চাই, জানালেন প্রদীপ। বাগবাজার পুজো কমিটির কর্তা অভয় ভট্টাচার্য বলেন, “আসলে আদি কলকাতার পুজোর নস্টালজিয়াই মানুষকে বাগবাজারে টেনে আনে।”
তবে, শুধু সাবেকিয়ানাই নয়, বাগবাজারের অন্যতম আকর্ষণ মণ্ডপ চত্বরের মেলাও। ইদানীং কলকাতার অনেক পুজোতেই আশপাশের মাঠে মেলা বসে। কিন্তু সে সবের থেকে বাগবাজারের স্বাদ অনেকটাই আলাদা বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা।
সাবেকিয়ানার লড়াইয়ে উত্তরের যদি বাগবাজার থাকে, দক্ষিণ কলকাতায় রয়েছে ‘ম্যাডক্স স্কোয়ার’। আর এই পুজো বলতেই যেটা মনে পড়ে, তা হল আড্ডা।
সকাল ১০টাই হোক বা রাত ৩টে, ম্যাডক্স স্কোয়ারের মাঠে জায়গা মেলা ভার। আর সঙ্গে চটপটি চাট থেকে ভেলপুরি, পাওভাজি, হাতে গরম বিরিয়ানি কী নেই সেখানে। প্রতিবার পুজোয় ম্যাডক্সে ঘাঁটি গাড়া এক তরুণীর বক্তব্য খানিকটা এমনই।
ম্যাডক্সের পুজোকর্তাদের দাবি, তাঁদের পুজো শুধু প্রতিমা দর্শনের মধ্যে আবদ্ধ নেই। বরং মণ্ডপ চত্বরের মাঠ হয়ে ওঠে এক মিলন ক্ষেত্র। এই কথার রেশ ধরেই উত্তর কলকাতার এক যুবক সুমিত বাগচী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পরে আমার সব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় ম্যাডক্সেই। এই মাঠে বসেই সারা রাত আড্ডা চলে।” সাবেকিয়ানার টানে তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি সেখানে ভিড় জমান বয়স্করাও। ম্যাডক্স স্কোয়ারের পুজো কমিটির কর্মকর্তা সুবীর মিত্র জানান, তাঁদের একচালার প্রতিমার গায়ে সব সোনার গয়না। এই ধারাই গত ৫০ বছর ধরে বজায় রেখেছেন তাঁরা। সুবীরবাবুর কথায়, “সাবেকিয়ানা ও তারুণ্যের মেলবন্ধনই আমাদের ইউএসপি।”
সাবেকিয়ানার দৌড়ে আছে উত্তর কলকাতার ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’ও। কলকাতার প্রাচীনতম এই পুজোর মণ্ডপে বহু বছর ধরেই দেখা মেলে সাবেকি সাজে একচালার প্রতিমার। আর তার টানেই প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ হাজির হন এই মণ্ডপে।
এই পুজোগুলির বাইরে কয়েকটি পুজো রয়েছে, যারা সাবেকিয়ানা খানিকটা ছাড়লেও কিছু রীতিনীতি বজায় রেখে চলছে। যেমন উত্তর কলকাতার ‘কাশী বোস লেন’ বা দক্ষিণের ‘একডালিয়া এভারগ্রিন’। কাশী বোস লেনের পুজোয় এ বার থিমের ছোঁয়া লাগলেও পুজোর ভোগ বা অষ্টমীর রাতে অর্ধরাত্রি পুজোর কোনও বদল করা হচ্ছে না বলেই পুজোকর্তারা জানিয়েছেন। ষষ্ঠীর বিকেল থেকেই ভোগ শুরু হয়ে গিয়েছে এই পুজোয়। ঠিক একই ভাবে মণ্ডপে পরিবর্তন আসলেও রমেশ পালের তৈরি বিশাল সাবেক প্রতিমায় কোনও পরিবর্তন আসেনি একডালিয়ায়। এখানকার বিখ্যাত অষ্টমীর ভোগের কথাও সুবিদিত। এর পাশাপাশি, দীর্ঘদিন ধরে সাবেক পুজো করে আসছে ‘বেহালা ইউনিক পার্ক আগমনী পুজো কমিটি’ও। |