পুজো আর ষষ্ঠীর বোধনের অপেক্ষা করছে না। চতুর্থী, পঞ্চমীতেও কলকাতা ভেসে যাচ্ছে জনজোয়ারে। শহরের এই সাম্প্রতিক ‘ট্রেন্ড’ ধরে ফেলেছে পুজো কমিটিগুলি। তাই দ্বিতীয়া থেকেই বড় পুজোগুলোর উদ্বোধন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাদের এটা আগে ধরা উচিত ছিল, তারাই পড়েছে পিছিয়ে।
তারা কলকাতা পুলিশ। যারা এখনও পড়ে আছে সাবেক রীতিতে। বহু বৈঠক-আলোচনার পরেও শেষ পর্যন্ত পুজোর ভিড় সামলাতে যারা পথে নেমেছে ষষ্ঠীর বিকেলেই। যার নিট ফল, পঞ্চমীর রাতে তো বটেই, ষষ্ঠীর সন্ধ্যাতেও যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকেছে গাড়ি। নাকাল হয়েছেন শহরবাসী।
ষষ্ঠীর বিকেলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশ যখন পথে নেমেছে, তত ক্ষণে পরিস্থিতি অনেকটাই হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। রবিবার নিউমার্কেটে কেনাকাটা সেরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গাড়িতে চড়েছিলেন আত্রেয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়। যানজটে হোঁচট খেতে খেতে সন্ধ্যা সাতটায় তিনি পৌঁছেছেন শ্যামবাজারে।
এ তো পুলিশ ভিড় সামলাতে নামার পরের পরিস্থিতি! তা হলে কী অবস্থা ছিল পঞ্চমীর রাতে?
রাত দেড়টায় নিউ আলিপুর পেট্রোল পাম্পকে কেন্দ্র করে যে দিকে যত দূর চোখ যায়, সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। সঙ্গে মানুষের থিকথিকে ভিড়। স্বভাবতই গাড়ি ও মানুষের মধ্যে চলল একে-অন্যকে টেক্কা দিয়ে ট্র্যাফিক-বিধি ভাঙার খেলা। মাঝে মধ্যে হাতে-গোনা যে ক’জন পুলিশকর্মীর দেখা মিলল, তাঁদের পক্ষে প্রতি মুহূর্তে বাড়তে থাকা গাড়ির বিশৃঙ্খল ভিড় সামলানো কার্যত অসম্ভব! আলিপুর, চেতলা, তারাতলা কিংবা টালিগঞ্জ ফাঁড়ি, যে দিকেই চোখ গিয়েছে, ছবিটা সর্বত্র প্রায় একই রকম।
পঞ্চমী থেকে ষষ্ঠীর রাত পর্যন্ত শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা সামলাতে এ ভাবেই কার্যত নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে পুলিশকে। আর এর জন্য পুজো কমিটির কর্তারও দায়ী করেছেন পুলিশের ট্র্যাফিক পরিকল্পনাকেই।
গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ‘বর্ধিত’ এলাকা কলকাতা পুলিশের আওতায় আসার পর এ বারের পুজোর ভিড় সামলানোই ছিল সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই পরীক্ষায় পঞ্চমীর রাতে কার্যত ‘ডাহা ফেল’ কলকাতা পুলিশ। রাস্তায় বেরনো মানুষের প্রশ্ন, শনিবার ছুটির দিন রাস্তায় ঠাকুর দেখার ভিড় যে বাড়তে পারে, তা কেন আগাম আঁচ করতে পারেনি পুলিশ? এ বার কলকাতার পুজোর উদ্বোধন শুরু হয়েছে দ্বিতীয়া থেকে। শহরের অর্ধেক মণ্ডপের দরজা খুলেছে চতুর্থীর রাতেই। পরিষ্কার আবহাওয়ায় মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন শুক্রবারই। তা সত্ত্বেও কেন পঞ্চমীর দিন পুলিশ নামানো হল না রাস্তায়?
পুলিশ সূত্রের খবর, এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়। ২০০৮ সাল থেকেই পঞ্চমীর রাতে ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। তাই পঞ্চমী থেকেই বাড়তি কর্মী মোতায়েন করা যায় কি না, তা নিয়ে সে বারেই আলোচনা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি লালবাজার। তাই এ বারও পঞ্চমী তো বটেই, ষষ্ঠীর সন্ধ্যা পর্যন্ত ভুগতে হল মানুষকে।
লালবাজারের কর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বুঝতে পারলেও, পর্যাপ্ত পুলিশকর্মী না থাকায় এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন, ভিড় সামলাতে প্রতিবারই ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত বাড়তি পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়। অন্যান্য বারের তুলনায় এ বার সেই সংখ্যাটা আরও বেশি। ওই ক’দিন বিকেল থেকে পর দিন ভোর পর্যন্ত টানা ডিউটি করতে হয় পুলিশকর্মীদের। তাঁদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই পঞ্চমীর দিনটাকে ছাড়ের আওতায় রাখা রয়েছে। পঞ্চমী বা তার আগে বাড়তি পুলিশকর্মী মোতায়েন করার ‘সামর্থ’ আপাতত তাঁদের নেই বলেই পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, পঞ্চমীর রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টারও বেশ কিছু ক্ষণ পর পর্যন্ত সব থেকে বেশি সমস্যা হয়েছে গড়িয়াহাট মোড়কে কেন্দ্র করে তিনটি রুটে। ডিসি (ট্র্যাফিক) দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওই তিনটি রুট হল:
কসবা-গড়িয়াহাট-রাসবিহারী, গড়িয়াহাট-পার্ক সার্কাস এবং গড়িয়াহাট-গোলপার্ক-ঢাকুরিয়া। যোধপুর ফার্স্ট ও সেকেন্ড লেন এবং মহারাজা ঠাকুর রোডে যে দু’টি ‘ক্রসওভার’ রয়েছে, সে দু’টিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর দড়ি না-ফেলার কারণে ওই এলাকায় যান-চলাচলে সমস্যা হয়েছে।” সমস্যা বাড়িয়েছে যথেচ্ছ ‘পার্কিং’। দুইয়ে মিলে মানুষে আর গাড়িতে জট পাকিয়ে এক সময় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ওই রাস্তাগুলি। শুধু দক্ষিণই নয়, সমস্যায় পড়েছিলেন মধ্য-উত্তর কলকাতার বড় পুজো মণ্ডপ সংলগ্ন রাস্তায় থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষও। পুলিশি নিয়ন্ত্রণ শিথিল দেখে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে অজস্র মালবাহী গাড়িও। কোনও রাস্তাই যান চলাচলের জন্য বন্ধ রাখা হয়নি, করা হয়নি একমুখীও। সমস্যা বাড়িয়েছে হকারদের বিকিকিনিও।
কিন্তু ষষ্ঠীর বিকেলে পুলিশ নামার পর থেকেই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। রাতের দিকে কসবা, নিউ-আলিপুর কিংবা গোলপার্কে মিনিট কুড়ির রাস্তা পেরোতে সময় লেগেছে আধ ঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট করে। তবে ডায়মন্ডহারবার রোডে যখন যানবাহন মসৃণ ভাবে চলেছে, তখন যথেষ্ট পুলিশ নামিয়েও রবিবারের রাতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি বেহালার জেমস লঙ সরনি কিংবা হরিদেবপুরের মহাত্মা গাঁধী রোডের যানজটকে।
উল্টো দিকে, উত্তর শহরতলির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ভিআইপি রোড ষষ্ঠীর রাতে যানজটে আটকে পড়েছে। বিমানবন্দরমুখী ওই রাস্তায় উল্টোডাঙা ব্রিজ পার হওয়ার পর থেকে থমকে গিয়েছে গাড়ি। উল্টোডাঙা থেকে বিমানবন্দর পৌঁছতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন, যে হারে গাড়ি বেড়েছে এবং বাড়ছে, তাতে যানজট হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আধুনিক শহরে যান চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা থাকার কথা ২০ শতাংশ। সেখানে কলকাতায় গাড়ি চলার রাস্তা ৮ শতাংশও নয় (৭.৮৩ শতাংশ)। তার উপরে অনেক রাস্তায় অর্ধেকটা জুড়ে পুজো মণ্ডপ হওয়ায় এবং জনজোয়ারের ফলে এই পরিমাণ আরও কমে যায়। এই অবস্থায় যানজটই ভবিতব্য বলে মনে করছেন ট্র্যাফিক পুলিশের কর্তাদের একাংশ।
অর্থাৎ আশঙ্কা রয়েই গেল, পরের পঞ্চমীও কি এমন বিভীষিকায় কাটবে? |