প্রত্যাবর্তন ও পরিবর্তন দু’টো শব্দই একাকার পুজোর আধারে।
দেবীবোধনের সন্ধ্যায় থিমের মোড়কে ভোল পাল্টানো শহরের বাঁকে বাঁকে মুগ্ধ জনতা বোধহয় দু’টোরই আভাস পাচ্ছিল। ফেসবুকে ‘আপলোড’ করবেন বলে যোধপুর পার্কের ‘সাঁচি স্তূপ’ ক্যামেরা-বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দমদমের শান্তনু রায়। অধৈর্য ভিড়ের ধাক্কাধাক্কিতেও ক্যামেরা উঁচিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ৩০ ছুঁইছুঁই যুবক। বছর দশেক আগে এই পুজোতেই রাজস্থানের দিলওয়ারা মন্দিরের ছবিটাও নাকি ঠেলেঠুলে ঢুকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
রাজস্থানি মন্দির বৌদ্ধ স্তূপে পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু পাল্টায়নি আম-দর্শকের আবেগ। কলকাতার সেই ‘দিলওয়ারা মন্দির’-এর রূপকার দীপক ঘোষই এ বার ফের যোধপুর পার্কে তাঁর ‘সাঁচি স্তূপ’কে নিয়ে ফিরে এসেছেন।
মাঝের একটি দশকে অন্য ধরনের থিমেও বিভিন্ন পুজোয় নজর কেড়েছিলেন দীপকবাবু। কিন্তু দিলওয়ারা মন্দিরের অদৃশ্য ছায়া থেকে বেরোতে পারেননি। কয়েক বছরের বিরতির পরে ফের তাঁর পুরনো মাঠে প্রাচীন স্থাপত্যের প্রতিকৃতির থিম নিয়ে এই ‘ফিরে আসা’ ঘিরে স্বভাবতই শহরের পুজো-পাগলদের ঔৎসুক্যের অন্ত নেই। দক্ষিণের ত্রিধারা সম্মিলনীতেও রাজপুতানার হাভেলি গড়ে তুলেছেন দীপকবাবু।
জমাটি ‘কামব্যাক ম্যাচ’ পুজোর থিমের আরও দুই তুখোড় খেলুড়ে, সঞ্জিত ঘোষ এবং পূর্ণেন্দু দে-র জন্যও। কয়েক বছর আগে লেকটাউনের নেতাজি স্পোর্টিংয়ে পাহাড়ি গুহার মণ্ডপের পরে ফিল্মি সেট ও পাপেট-বিশারদ সঞ্জিতবাবু হঠাৎ ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গিয়েছিলেন। এ বার ঢাকুরিয়ার অবসরিকা-য় পরীর দেশ ও যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লিতে দত্যি-দানোর দেশ নিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। পরীর দেশে মণ্ডপের সাজে পুতুল-পরীদের দেখতে দেখতে লেজার আলোয় স্নান করছে ভিড়-করা জনতা। দত্যিদানোর দেশে অসুরের ছড়াছড়ি। রোবটের মতো অসুরেরা এখানে মাফিয়ারাজ, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বা জঙ্গিপনার প্রতীক। সল্টলেকের এফডি ব্লকেও প্রকাণ্ড প্রতিমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঞ্জিতবাবুর দৌলতে মাথা তুলেছে বিশাল পাহাড়, যার গায়ে ছোট ছোট গুহায় শিবের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ।
|
আর্ট কলেজের কৃতী পূর্ণেন্দুবাবু অবশ্য থিমের মাঠ থেকে সরে যাননি। কিন্তু গত দু’বছর তাঁর আস্তিনের সেরা তাস ‘মাটির কাজ’ থেকে দূরে ছিলেন। ২০০৯-এ চক্রবেড়িয়ায় তকতকে কাগজ ও চিকচিকে অভ্র এবং গত বার অজেয় সংহতিতে রঙিন খেলনা-প্লাস্টিক নিয়ে কাজ করেছিলেন। এ বার বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের মাঠে ফের মাটি নিয়ে মেতেছেন তিনি। মুগ্ধ ভিড় বলছে, লোকায়ত মাটির সরার কাজে নিজের জাত চিনিয়ে দিতে কসুর করেননি এই শিল্পী।
থিম-পুজোর বাকি হেভিওয়েট অমর সরকার, বন্দন রাহা বা রূপচাঁদ কুণ্ডুদেরও এ বার নতুন মহিমায় পাওয়া যাচ্ছে। উত্তরের টালা বারোয়ারিতে সমকালের ছোঁয়ায় মজেছে দর্শককুল। সংবাদমাধ্যম বা কাগুজে বিজ্ঞাপনের সরণি ধরে ধর্মীয় আচার-ইতিহাস ও পুজোর রকমারি মোটিফ ছুঁয়ে অমরের ঠাকুর দেখেছে ষষ্ঠীর কলকাতা। মণ্ডপের সাজে পুরনো পত্র-পত্রিকার জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের ছবিতেও দানা বাঁধছে স্মৃতিমেদুরতা। হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীনের ‘কাচের স্বগের্’ ঠিকরে-পড়া আলোতেও ষষ্ঠীর কলকাতা যেন আরও মায়াবী।
দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘে বন্দন রাহা গ্রামবাংলার লোকায়ত আড়বাঁশি-করতালের থিম নিয়ে লড়ছেন। মুদিয়ালিতে বন্দনের টেক্কা, রংবেরঙের ইলেকট্রিক তার। দক্ষিণের বাবুবাগান বা উত্তরের কুমোরটুলি পার্কের থিমের বৈচিত্র্যে রূপচাঁদ কুণ্ডুও যেন দু’জন আলাদা মানুষ। বাবুবাগানের মণ্ডপে একেলে আর্ট গ্যালারি। ছবির প্যানেলে দেবীমূর্তি নিয়ে নানা ভাবনার ছাপ। কুমোরটুলি পার্কে কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের প্রতিই শ্রদ্ধার্ঘ। কুয়োর মাটির বেড়, ভাঁড়, খুরি, ধুনুচির সাজসজ্জাই অন্য মাত্রা পেয়েছে।
চলচ্চিত্রে অন্দরসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পনার রূপকার সুশান্ত পালের হাত ধরে দক্ষিণের পুরনো পুজো সঙ্ঘশ্রী-ও তাদের সোনালি দিনে ফেরার চেষ্টায়। সাবেক সঙ্ঘশ্রী-র প্রতিমার চারপাশে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির সঙ্গে মিল রেখেই তৈরি হয়েছে বিমূর্ত শিল্প-অবয়ব। প্রতিমার সাজে অভিনব কোলাজের ছোঁয়া।
আর এক শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার আরও বড় মাঠে খেলছেন। পুরনো মাঠ শিবমন্দিরের পুজোয় বাংলার ডোম সম্প্রদায়ের বাঁশ-বেতের কাজের মধ্যে নিপুণ হাতে তিনি মিলিয়েছেন পুব ভারতের রকমারি লোকশিল্পের ঘরানা। সেই সঙ্গে নিউআলিপুর সুরুচি সঙ্ঘের কাশ্মীর-এর নেপথ্যেও এ বার সুব্রতবাবু। কাশ্মীরি আলমকারি, কলামকারি, পশমিনার নানা ঘরানা মণ্ডপের সাজে মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ভিড় বলছে, অনির্বাণ দাসের জন্যও এ পুজোটা অবশ্যই স্মরণীয়। হাতিবাগান নবীনপল্লিতে চাল মাপার বেতের কুনকে বা বেহালা আদর্শপল্লিতে তালপাতার পাখা, চাটাই, বাঁশির সাজে তিনি নজর কাড়ছেন। চক্রবেড়িয়ায় একদা অমর সরকারের সহযোগী শিবনারায়ণ দাসের ‘শিউলিতলা’-ও এ পুজোর বিশেষ প্রাপ্তি। রান্নাঘরের ‘এগজস্ট ফ্যানে’র রং-করা পাখাই শহুরে মণ্ডপের শিউলি ফুল হয়ে ফুটছে। বেহালার দেবদারু ফটক ও বেলেঘাটার ৩৩ পল্লিতেও শিবনারায়ণের কাজ ভিড় টানছে।
থিমের বড়-মেজ শিল্পীদের এই রেষারেষির টানেই যানজটে গলদঘর্ম হয়ে লোক থই থই বরাহনগর থেকে বেহালা। আবার থিম ছাপিয়ে ঠাকুর দেখার সনাতনী আবেগও কিন্তু পুজোর কলকাতায় ফিরে ফিরে আসে। চাকরি সূত্রে চার বছর চেন্নাইয়ে থাকার পরে গড়িয়ার সুদীপ রায়ের এ বারই সপরিবার পুজোয় ফিরে আসা। উত্তরের ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে ইচ্ছে থাকলেও ষষ্ঠীর সকালে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে ভিড় ঠেলে আহিরীটোলার মণ্ডপে ঢুকতে পারলেন না তিনি। কুমোরটুলি হয়ে সল্টলেকে যাওয়ার আগে মণ্ডপের সামনে মা-বাবাকে নিয়ে কিছু ক্ষণ ছবি তুলতে দেখা গেল তাঁকে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত তরুণের কথায়, “এত বছর বাদে কলকাতার ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে মায়ের আর্জি ছিল, সবার আগে বাগবাজারের ডাকের সাজের ঠাকুর দেখতে হবে। তাই এতটা পথ উজিয়ে শুরুতেই উত্তরে আসতে হল।” |