|
|
|
|
|
|
|
বিপুল নিকট |
সমরেশ মজুমদার |
বিকেল থেকেই আকাশ মেঘে অন্ধকার। সকালে কালীদার চায়ের দোকানে বসে কাগজ হাতে নিয়ে সে জেনেছিল আজ কলকাতা ভাসবে। চারটে বাজতেই ঠিক করেছিল গাড়ি গ্যারাজ করে দেবে। মালিকের টাকা আর তেলের দাম উঠে গেছে যখন, তখন আর লোভ না করাই ভাল। কিন্তু ক্যালকাটা হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো দুটো মানুষকে দেখে না দাঁড়িয়ে পারেনি অজয়। বুড়ো-বুড়ি। পরস্পরকে ধরে দাঁড়িয়ে, বুড়োর একটা হাত কাঁপতে কাঁপতে তাকে থামতে বলছে। ছুটোছুটি করে ট্যাক্সি ধরার ক্ষমতা এঁদের নেই। অজয়ের গ্যারাজ ভবানীপুরে, ওই দিকে যদি যায় তা হলে নামিয়ে দিতে অসুবিধে নেই। গাড়ি থামিয়ে সে চেঁচিয়েছিল, ‘কোথায় যাবেন?’
বুড়ি আঁকড়ে ধরেছিল গাড়ির দরজা, ‘আমাদের বাড়ি পৌঁছে দাও বাবা। ওর মাথা ঘুরছে, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। যা চাইবে তাই দেব।’
হেসে ফেলেছিল অজয়, ‘উঠে পড়ুন।’
পিছনের সিটে বসেই বুড়ো বলেছিল, ‘আঃ। বেঁচে গেলাম।’ ‘বাড়ি কোথায়? ভবানীপুর না চেতলায়?’ ‘অ্যাঁ?’ বুড়ি মাথা নেড়েছিল, ‘না, না। আমরা থাকি সল্ট লেকে। করুণাময়ীতে। বোনের অপারেশন হয়েছে, দেখতে এসেছিলাম।’
সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক চেপেছিল অজয়। সর্বনাশ। এখান থেকে সল্ট লেকে যেতে লাগবে ঘণ্টাখানেক। তার পর ফিরতে হবে খালি গাড়ি নিয়ে। বৃষ্টি তো শুরু হয়ে যাবেই। সে পিছনে তাকাল। বুড়ো চোখ বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে বসে আছে, বুড়ি তার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে আছে। এঁদের নেমে যেতে বলবে কী করে!
অতএব কপালে দুঃখ আছে ভেবেই গাড়ি ঘুরিয়েছিল অজয়। পার্ক সার্কাসের চার নম্বর ব্রিজের ওপর উঠতেই বৃষ্টি নামল। সঙ্গে বিদ্যুৎ আর বাজ সঙ্গত করল। ‘কাচ তুলে দিতে পারবেন, ঠাকুমা?’ ‘হ্যাঁ বাবা, পারব।’
যত এগোচ্ছে তত বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। হেডলাইটের আলো রাস্তা পরিষ্কার করতে পারছে না। সব সাদা। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে থেমে যেতে হচ্ছিল অন্যান্য গাড়ির মতন। করুণাময়ীতে পৌঁছতে দেড় ঘণ্টা লাগল। বিশেষ একটা বাড়ির সামনে বুড়ির কথায় গাড়ি থামাল সে, ‘নামবেন কী করে? কী জোর বৃষ্টি পড়ছে দেখছেন না?’ ‘ওই তো বাড়ি। দরজায় তালা দিয়ে গিয়েছি। তালাও খুলতে হবে। তোমাকে কতক্ষণ আটকে রাখব বাবা?’ বুড়ি বলল।
এ বার বুড়ো সোজা হল, ‘কত হয়েছে ভাই?’
মিটার দেখে টাকার অঙ্কটা বলল অজয়।
পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে গুনে গুনে টাকাটা দিয়ে দিল বুড়ো। বুড়ি বলল, ‘তুমি বসো। আমি গিয়ে তালা খুলে ছাতিটা নিয়ে আসি।’ ‘তখনই বলেছিলাম ছাতি নিয়ে বেরোও, শুনলে না!’ বুড়োর গলায় রুষ্ট ভাব। |
|
‘কাকে সামলাব? তোমাকে না ছাতিকে? বসো, আসছি।’
অজয় দেখল বুড়ি টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের বাড়ির দরজার দিকে। সে বুড়োকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা ছাড়া আর কে কে থাকে এ বাড়িতে?’ ‘দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুটো থাকে আমেরিকায়, মেয়ে-জামাই কেনিয়ায়। আমরা মরে যাওয়ার পর এসে বাড়ি বিক্রি করে দেবে। তদ্দিন...!’ বুড়ো কথা শেষ করল না। ‘ওদের কাছে চলে যাচ্ছেন না কেন?’ অজয় প্রশ্নটা না করে পারল না। ‘ওরা ওদের মা গেলে খুশি হবে, কিন্তু আমাকে ছেড়ে ইনি কোথাও যেতে চান না যে!’
দরজায় আওয়াজ হল। বুড়ো সেটা খুলতেই বুড়ির গলা শোনা গেল, ‘এসো। ছাতাটা তুমি নাও, আমি তো ভিজে একসা। এখনই বাথরুমে ঢুকব।’
বুড়ো ছাতি মাথায় বুড়ির হাত ধরে চলে যেতেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিল অজয়। তার মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হল মানুষের বেশি দিন একা একা বাঁচা ঠিক নয়। অবশ্য ওঁরা তো একা নয়, দু’জনে রয়েছেন। ছেলেমেয়ে থাকতেও দু’জনের একা হয়ে থাকাটা ভয়ঙ্কর কষ্টের। পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও তার বাবা-মায়ের এই সমস্যা নেই। উঠোনের চার পাশে কাকা জ্যাঠারা আছেন। চাষবাসও একসঙ্গে। ছেলেরা চাকরি করতে বাইরে গিয়েছে বটে, কিন্তু নিয়মিত টাকা পাঠায়। সেই টাকা প্রয়োজন পড়লে অন্যের সমস্যার সমাধান করে। চেষ্টা করলেও কেউ একা হতে পারবে না ওখানে।
বৃষ্টিটা আরও বাড়ল। কাচ থেকে জল সরাতে পারছে না কাঠিটা। ওপাশ থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট জ্বলছে ডাইনির চোখের মতো। এ ভাবে আরও আধ ঘণ্টা ঢাললে কলকাতার রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে যাবে। শালা! বুড়ো-বুড়ির উপকার করতে গিয়ে সে ফেঁসে গেল। কোনও রকম চিংড়িঘাটায় পৌঁছে সে গাড়ি রাস্তার ধারে পার্ক করল। নাঃ, এ ভাবে অজ্ঞের মতো বাইপাসে গাড়ি চালানোর ঝুঁকি সে নেবে না। রাত হোক। মালিক মিটার বাড়াতে চাইলে ঝগড়া করতে হবে। মনে হল বৃষ্টিতে ফেঁসে যাওয়ার খবরটা মালিককে জানিয়ে রাখাই ভাল। সে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম বের করে বোতাম টিপল। রিং হচ্ছে। তার পর গলা পেয়ে ব্যাপারটা বলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মালিক চিৎকার করল, ‘বৃষ্টি আসছে তুমি জানতে না? সব ক’টা কাগজে লিখেছে মারাত্মক ডিপ্রেশন হয়েছে, দেখোনি! তবু খিদিরপুর থেকে চলে গেলে সল্ট লেক? নাইট শিফটের ড্রাইভার আসবে রাত ন’টায়। যেমন করে হোক তার আগে এসো।’ লাইন কেটে দিল মালিক। একটুও রাগ করল না অজয়। এখন মাত্র পৌনে সাতটা। সাধারণ সময়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে ভবানীপুরে পৌঁছে যেত। এখন দু’ঘণ্টার ওপর সময় হাতে আছে। পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে সে লাল কাপড়টা দিয়ে সামনের কাচটা মুছতে যেতেই মোবাইলের রিং শুনতে পেল। আবার পকেটে হাত দিতে গিয়ে থমকে গেল সে। আওয়াজটা আসছে পিছনের দিক থেকে। সে ওপরে আলো জ্বেলে ব্যাক সিটটাকে দেখল। কিছু নেই। তার পর শব্দের উৎস বুঝে শরীর হেলিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে আলো জ্বলতে দেখল। ব্যাক সিটের পা রাখার জায়গায় একটা মোবাইল পড়ে আছে। বাজতে বাজতে থেমে গেল সেটা, আলো নিভে গেল।
অনেক কসরত করে মোবাইলটাকে হাতে পেল অজয়। সাধারণ চেহারার মোবাইল। নিশ্চয়ই কোনও প্যাসেঞ্জার ফেলে গেছে ভুল করে। তার গাড়িতে উঠে কেউ কি মোবাইলে কথা বলেছিল? মনে পড়ছিল না। এই মাত্র যে নম্বর থেকে ফোনটা এসেছিল তার সঙ্গে কথা বললে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে ভেবে বোতাম টিপল অজয়। নম্বরটা ল্যান্ড লাইনের।
রিং হচ্ছে। তার পরই গলা শুনতে পেল, ‘হ্যালো!’ ‘আপনারা কেউ কি একটা মোবাইলে রিং করেছিলেন একটু আগে?’ ‘হ্যাঁ, হ্যা।ঁ আমার মোবাইল। কোথায় ফেলেছি মনে করতে পারছি না। হয় হাসপাতালে, নয় ট্যাক্সিতে। আপনি কে ভাই?’ ‘আপনি আমার ট্যাক্সিতেই ওটা ফেলে গেছেন।’ ‘ও, তুমি। এই শোনো, যে ছেলেটি আমাদের পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল, সে ফোন করছে। ওর গাড়িতেই মোবাইলটা ফেলে এসেছি। ওই মানিব্যাগ বের করার সময় হয়তো পকেট থেকে পড়ে গিয়েছে। হ্যাঁ ভাই, তুমি এখন কোথায়?’ বুড়ো জিজ্ঞেস করল। ‘চিংড়িঘাটায়’। অজয় জবাব দিল। ‘ও বাব্বা! কী হবে? মুশকিল হল আমার ছেলেমেয়েরা ওই মোবাইলেই ফোন করে। তা ঠিক আছে, তুমি আবার যখন কোনও প্যাসেঞ্জার নিয়ে সল্ট লেকে আসবে তখন দিয়ে যেয়ো।’
অজয় সুইচ অফ করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
যে ছেলেমেয়ে বাপ-মাকে একা ফেলে রেখেছে তাদের ফোনের জন্যে বুড়ো এখনও উদগ্রীব হয়ে থাকে! এক বার মনে হল তার কী দরকার এখনই মোবাইলটা ফেরত দেওয়ার। এই যে তেল পুড়বে, সময় যাবে, তার দাম কি বুড়ো দেবে? ভাবতেই ঠোঁট কামড়াল। এ রকম হলে বুড়োর ছেলেরা যা ভাবত, তাই সে ভাবছে! দূর!
তখনও বৃষ্টি সমানে চলছে। বাড়ির সামনে পৌঁছে হর্ন দিল অজয়। বৃষ্টিতে ভেজার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। দ্বিতীয় বার হর্ন বাজানোর পর দরজায় আলো দেখা গেল। ছাতি মাথায় বেরিয়ে এল বুড়ি। জানলার কাচ সরিয়ে মোবাইল তাঁর হাতে দিতে বুড়ি বলল, ‘একবার ভেতরে আসতে হবে বাবা। এক কাপ চা খেয়ে যাও।’ ‘না, না। খুব দেরি হয়ে গেছে। আবার কখনও এ দিকে এলে নিশ্চয় চা খেতে আসব। আচ্ছা চলি।’ কাচ তুলে গাড়ি ঘোরাল অজয় দরজা লক করে।
এখন রাস্তায় মানুষ দূরের কথা একটা নেড়ি কুকুরও নেই। পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত কোনও গাড়িই চোখে পড়ছে না। আকাশটা যেন আর বৃষ্টি ধরে রাখতে পারছে না। খানিকটা যেতেই একটা অ্যাম্বাসাডার দেখতে পেল সে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দুটো মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়ে হাত তুলে তাকে থামতে বলছে। এরা যদি সাউথে যায়, তা হলে খালি গাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে না।
সে গাড়ি থামাতেই লোক দুটো গাড়ির ওপর আছড়ে পড়ল। এক জন চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাই, দরজা খোল। ডাবল ভাড়া দেব!’
সে কাচ নামাল, ‘কোথায় যাবেন?’
দ্বিতীয় জন চেঁচাল বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে, ‘তাতে তোর কী। ডাবল মাল নিবি পৌঁছে দিবি। তাড়াতাড়ি কর, টুনটুনি ভেগেছে, তুলতে হবে।’
লোক দুটো যে আকণ্ঠ মদ গিলেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এদের গাড়িতে নিলে বিপদে পড়তেই হবে। কাচ তুলে অ্যাকসেলারেটারে চাপ দিল অজয়। গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্র অশ্রাব্য গালাগালি শুরু করল লোক দুটো। অন্য সময় হলে অজয় গাড়ি থামিয়ে নীচে নামত। লোক দুটোকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ফিরে আসত। এখন এই বৃষ্টি ভিজতে একটু ইচ্ছে হচ্ছে না। বেঁচে গেল জন্তু দুটো।
সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল অজয়। ইতিমধ্যেই গর্তগুলো জলে ভরে গেছে। সেখানে চাকা যদি জোর গতিতে পড়ে তা হলে গাড়ির বারোটা বেজে যাবে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আচ্ছা, ওই মাতাল দুটো এই বৃষ্টিতে গাড়ি থামিয়ে কী করছিল ওখানে? গাড়ি কি খারাপ হয়ে গিয়েছিল? নিশ্চয়ই তাই। নইলে নিজেদের গাড়ি ছেড়ে ট্যাক্সিতে উঠতে যাবে কেন? বৃষ্টির মধ্যে গাড়িতে বসে মাল খাওয়ার পার্টি কলকাতায় প্রচুর। ব্যাপারটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। রাতে মাতাল দেখলে কোনও ট্যাক্সিওয়ালা দাঁড়াতে চায় না, যদি না ড্রাইভারের মতলব খারাপ থাকে।
একটা গর্ত বুঝতে পারেনি সে, গাড়ি লাফাল। শালা! অন্যমনস্ক হলেই বিপদ লাফিয়ে সামনে আসে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খুব। মুহূর্তের জন্যে সামনের পথ সাদা হয়েই আরও অন্ধকার হচ্ছে। হেডলাইটের আলোকে বৃষ্টি গিলে ফেলছে।
নিকো পার্ক ছাড়াবার পরে রাস্তায় জল নেই দেখে সে গাড়ির গতি একটু বাড়াতেই বিদ্যুৎ চমকাল। কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যে সে দেখতে পেল রাস্তার মাঝখান দিয়ে কেউ দৌড়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা মাথায় ঢোকার আগে গাড়ির ঠিক সামনে একটা মানুষকে দেখতে পেয়ে সাডেন ব্রেক চাপল অজয়। গাড়ি একই জায়গায় প্রচণ্ড প্রতিবাদ করে দাঁড়িয়ে গেল। আবার বিদ্যুৎ চমকাল তখন, কিন্তু কেউ সামনে দাঁড়িয়ে নেই।
কিন্তু লোকটাকে সে সামনে দেখেছে। আর তার গাড়ি যে লোকটাকে স্পর্শ করেনি তাতে সে নিঃসংশয়। কিন্তু গেল কোথায়? গাড়ির সামনে পড়ে যায়নি তো? ধাক্কা যদি না লাগে তা হলে পড়বে কী করে?
কিন্তু যদি সামনে পড়ে থাকে তা হলে গাড়ি তো ওর ওপর দিয়ে যাবে। সে ঘড়ি দেখল। হাতে মাত্র দেড় ঘণ্টা রয়েছে। কী করবে। ব্যাক করল সে। খানিকটা পিছিয়ে যেতেই হেডলাইটের আলোয় দেখতে পেল এক জন রাস্তার মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বৃষ্টি যে শরীরটার ওপর পড়ছে, সেটা পুরুষের নয়।
না। সে ধাক্কা মারেনি। তা হলে মহিলা পড়ল কী করে? বেঁচে আছে তো? ওকে ওইখানে ফেলে পাশ কাটিয়ে সে চলে যেতেই পারে। তার পর লাল কাপড়টা তুলে মাথায় পাগড়ির মতো তুলে নীচে নামতেই জলের ঝাপটা লাগল শরীরে। মহিলার কাছে গিয়ে সে চিৎকার করল, ‘কী হয়েছে আপনার? এই যে!’
কোনও সাড়াশব্দ নেই। সে শরীরটাকে চিৎ করে দিতেই বিদ্যুৎ চমকাল। সেই আলোয় বুঝতে পারল ওর বয়স চব্বিশের বেশি নয়। নাকের নীচে আঙুল রাখতেই বুঝতে পারল শ্বাস পড়ছে। একে কোনও হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। দৌড়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে আবার এগিয়ে এসে মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল অজয়।
পেছনের সিটে ওকে বসাতেই মাথাটা কাত হয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে অজয় যখন ড্রাইভিং সিটে বসল, তখন তার সর্বাঙ্গ থেকে জল ঝরছে। গাড়ির বারোটা বেজে গেল। মালিক আজ তার শ্রাদ্ধ করবে।
গাড়ি চালু করল সে। সোজা বাইপাস দিয়ে রুবি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই উচিত। কিন্তু...! মাথা নাড়ল অজয়। হাসপাতালে গিয়ে সে মেয়েটার পরিচয় তো কিছুই দিতে পারবে না। অ্যাকসিডেন্ট হয়নি, রাস্তা থেকে অজ্ঞান অবস্থায় তুলে নিয়ে এসেছে বললে তো পুলিশ কেস হয়ে যাবে। পুলিশ তাকে সহজে ছাড়বে না।
সে পিছন ফিরে চিৎকার করল, ‘এই যে, কে আপনি?’ কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। হঠাৎ মাতাল দুটোর কথা মনে এল। ওদের এক জন বলেছিল, টুনটুনি ভেগেছে, ওকে তুলতে হবে। তা হলে এই মেয়েই সেই টুনটুনি! ওই মাতালদের সঙ্গে কী করছিল?
ততক্ষণে গাড়ি বাইপাসে উঠে গেছে। অজয়ের মনে হল, ঝুটঝামেলায় না গিয়ে ওকে রাস্তার এক পাশে নামিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু কোথায় নামাবে। যদিও বাইপাসে এখন গাড়ি কম কিন্তু দৃশ্যটা কেউ না কেউ দেখতে পাবেই। একটা পুলিশের ভ্যানকে সে দেখতে পেল রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে ভিজছে। ধরা পড়লে কোনও কৈফিয়ত পুলিশ শুনবে না। ‘এত ভাবছ কেন? তুমি তো প্রকৃত মানুষের যা করা উচিত, তাই করেছ।’
কে বলল কথাটা? গলাটা কোনও বয়স্ক মানুষের। গাড়িতে সে আর অজানা মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। শালা, আজ কী যে সব হচ্ছে! তবু সে পিছনের দিকে তাকিয়েই ব্রেকে চাপ দিল। একটি টাকমাথার বুড়ো মেয়েটির মাথার পাশে বসে আছে। সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে আপনি? কী করে গাড়িতে উঠলেন?’ ‘ভাল করে তাকিয়ে দেখো, বোধ হয় আমাকে চিনতে পারবে।’ বৃদ্ধ হাসলেন। |
(ক্রমশ)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|