রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
মা তো মৃন্ময়ী নন, চিন্ময়ের
বাংলাদেশের কুমিল্লায় আমাদের আদি বাড়ি ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার দাদু সপরিবার চলে আসেন ভবানীপুরে। নর্দার্ন পার্কের কাছে।
প্রথম যে পুজোটা আমি উপভোগ করেছিলাম সেটা হল নর্দার্ন পার্কের বালক সঙ্ঘের পুজো। বিরাট পুজো। এবং পুজোর সময় যে তুবড়ি প্রতিযোগিতা হত, সেই দেখে আমি তো একেবারে আনন্দে আত্মহারা। কত রকমের তুবড়ি উড়ন্ত তুবড়ি, বসানো তুবড়ি। পুজোর এক মাস আগে থেকে একটা হিমেল হাওয়া বইত, একটা শীত শীত ভাব, শরতের সাদা মেঘ, কাশ বন, এখন সে সব কোথায়? তখন নেতাজিনগরের দিকে গেলে কাশফুল দেখা যেত। এখন সেখানে বসতি তৈরি হয়ে গেছে। এখন যেমন হিন্দি গানের দৌরাত্ম্যে ঢাকের আওয়াজ হাপিশ হয়ে গেছে, তখন কিন্তু ঢাকের আওয়াজটা বেশ জোরালো শোনা যেত। এখন অবশ্য কাশফুল মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে, যখন গাড়ি করে কোথাও মা’র মূর্তি উন্মোচন করতে যাই।
পুজোর আগে কে কী দেবে একটা ছেলেমানুষির এক্সপেকটেশন থাকত। আমার ঠাকুমার মা, আমরা যাঁকে দিদা বলতাম, ১০১ বছর বেঁচে ছিলেন। নীরোগ অবস্থায়। তিনি আমাদের পুজোর সময় রুপোর চার আনা করে দিতেন। ষষ্ঠীর দিন একটা, সপ্তমীর দিন একটা, অষ্টমীর দিন দুটো সিকি। নবমীর দিনে আবার একটা, দশমীর দিনে ভূরিভোজ। অন্যদের থেকে আমাকে একটু বেশিই ভালবাসতেন। আমি বাড়ির ছোট ছিলাম তো। আমরা ছ’জন ভাইবোন। সেই সময় একান্নবর্তী পরিবার, তাই বাড়ির বড়দের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক পুজোর সময়টাতেই মনে চাগাড় দিত। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু দিত।
পাশেই এক ক্রিশ্চান পরিবারের বাস ছিল। ওদের ছেলেমেয়েরা দুর্গাপুজো ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারত না। ওরা বলত, তোমাদের উৎসবটাতে ঠিক মজা পাই না। তখন আমি বলতাম, তোমাদের যেমন বড়দিন হয়, সে রকম আমাদের দুর্গাপুজো। তোমরা ক্রিসমাস উপভোগ করো, আমরা দুর্গাপুজো।
ওই পাড়ায় থাকতে মনে আছে, পুজোর সময় ঘুরতে ঘুরতে নেতাজির বাড়ি চলে যেতাম। সেটাও একটা মজার ব্যাপার ছিল। আমাদের পাড়ার উত্তর দিকের একটা গলি ছিল, ওই গলি দিয়ে সো-ও-জা গেলেই নেতাজির বাড়ি। আর ওখানে গেলেই নেতাজির অন্তর্ধানের নানা রকম গল্পটল্প শুনতে পেতাম ওই বাড়ির দরজায় দাঁড়ানো দারোয়ানজির কাছ থেকে। এই গল্প আমায় খুব টানত। এবং নেতাজির প্রতি আমার একটা আলাদা টানও ছিল। ক্লাসে কিছু আঁকতে পারি আর না পারি, কিন্তু নেতাজির মূর্তি হরবখত এঁকে ফেলতাম।
তখন গোটা ভবানীপুরে একটাই পুজো হত। বালক সঙ্ঘ। এখনকার মতো গায়ে গায়ে পুজোর মতো নয়, এত কম্পিটিশন ছিল না। ডাকের কাজ বা শোলার কাজ হত। থিম পুজো বলে কোনও শব্দ ডিকশনারিতে ছিল না। ষষ্ঠী এলে সকালে বেরিয়ে পড়তাম। নীরদ কাকার দেওয়া জুতো ‘নটি বয়’ পরে। চিনি কাকা বেকার, তবু সে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি দিয়েছে। ঠাকুমা কিছু না কিছু দিতেন। মা কিনে দিতেন বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে। বাবা অমিয়প্রসাদ রায় ওকালতি করতেন। বাবাকে আমরা খুব একটা পাইনি, বাইরে বাইরেই থাকতেন। মাকেই বেশি পেয়েছি। মা পুজোর সময় সাজিয়ে দিতেন। থুতনি ধরে চুল আঁচড়ে দিতেন মা। ‘পথের পাঁচালী’র অপুর মায়ের মতো। আমরা সেজেগুজে বেরোতাম। ষষ্ঠীর জামাকাপড় আলাদা থাকত, সপ্তমীর আলাদা, অষ্টমীর আলাদা, নবমীর আলাদা, দশমীর দিন ধুতি আর সেই সময়কার পাঞ্জাবি পরতে হত। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে না পারি নড়তে, না পারি চড়তে, তবু পরতাম, এটাই নিয়ম ছিল। সে সব পরে অঞ্জলি দিতে যেতাম। এবং পুজোর যা যা অঙ্গ তাই করতাম। যেহেতু আমাদের পাড়াতেই পুজো, তাই পুজোর ওই ক’টা দিন বেশির ভাগ সময়টাই কাটত পুজোর প্যান্ডেলে। অবশ্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অন্য কোনও জায়গায় পুজো পরিক্রমাও করতাম।
গ্রাফিক: অরিন্দম মজুমদার
ওই সময় একটা অসুবিধেয় পড়তাম। তখন ‘নটি বয়’ শু এত পপুলার ছিল, আমাদের মতো বাচ্চারা বাড়ির বড়দের কাছে একটাই বায়না করত, এ বার পুজোয় ‘নটি বয়’ চাই। সমস্যাটা হল, নতুন জুতো পরে পুজো পরিক্রমা করলেই পায়ে অবধারিত ফোস্কা পড়ে যেত। ফোস্কা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই জুতোটা পরেই কিন্তু ঠাকুর দেখতে যেতাম। ষষ্ঠীর দিন নর্দার্ন পার্ক, সপ্তমীর দিন ২৩ পল্লি, এ ভাবে অষ্টমী, নবমী একটার পর একটা ঠাকুর দেখা চলত। ছোট বলে তখন উত্তর কলকাতায় যাওয়া বারণ ছিল।
পুজোর আগে থেকেই পয়সা জমাতাম। দিদা পুজোর সময় যা পয়সা দিত, সেই সব মিলিয়ে আমরা মুখরোচক খাবার কিনে খেতাম। যেখানে রেগুলার খেতে যেতে পারতাম না, সেখানে খেতে যেতাম। ফুচকা খাওয়া ছিল পুজোর সময় একটা বিরাট ব্যাপার। ফুচকা খেতে খেতে যদি টক জল জামায় পড়ত, তৎক্ষণাৎ জল দিয়ে সেটাকে রগড়ে ধুয়ে দিতাম। বড় পুজোতে সব খরচ করে ফেললে হবে না, এই ভেবে অন্তত কিছুটা বাঁচাতাম। না হলে লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজোয় হাতটান পড়ে যাবে না!
আর একটা জিনিস হত। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিনে তিনটে নাটক হত নর্দার্ন পার্কে। আমরা রাত জেগে নর্দার্ন পার্কে ঐতিহাসিক নাটক দেখতাম। থিয়েটারে ভিলেনকে মারা হচ্ছে, কী মজা আমাদের। আমরা হাততালি দিতাম। ঝলমলে পোশাক-আশাক, ঝনঝন করে বাজনা বাজছে দেখে তখন থেকেই আমি থিয়েটারের প্রতি টান অনুভব করি। সপ্তমী-অষ্টমী দু’দিন রাত জেগে নবমীর দিন সকালে চোখ রাঙা রাঙা করে ঢুলতে ঢুলতে পুজো দেখতে বেরোতাম। বাড়ির লোক বলত, একটু ঘুমায়ে নে না বাছা। কিন্তু ঠাকুর দেখার আনন্দে কিছুতেই চোখে ঘুম আসত না।
আবার এক ঝড় এল দেশভাগ। দাঙ্গা। এক একটা অঞ্চল জ্বলছে, আর গুজবে পুড়ছে অন্য অঞ্চল। ভেবে অবাক হই, একই কালচার, একই ভাষা, তবু কেন এত ভেদাভেদি। এই জাতপাতের বিভেদ আমায় খুব নাড়া দিত। হিন্দু-মুসলমান মারামারি করছে, খুনোখুনি করছে। এ সব দেখে কষ্ট হত।
সে সময় দেশভাগের মতোই সেপারেট হয়ে গেল আমাদের ফ্যামিলি। আমরা চলে গেলাম বরানগরে। আমার ঠাকুমা ছিলেন খুব ধার্মিক তাই বরানগরটাই বাছলেন। কারণ, কাছেই দক্ষিণেশ্বর।
ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম কাশীপুর ইনস্টিটিউশনে। বরানগরে এসে দারুণ এনজয় করেছি। কোনও বাধা ছিল না। যখন খুশি বেরিয়ে পড়তাম। সে ছিল এক অদ্ভুত স্বাধীনতা। কেউ কিছু বলত না। নিজের মতো করে ঘুরতাম, নিজের মতো করে পড়াশোনা করতাম। এই রকম ফ্রিডম পাওয়ার পর পুজোগুলোতে দারুণ মজা হত। এক বার হয়ে ছিল কী, রোজই গঙ্গায় স্নান করতে যাই। এক বন্ধু বলল আজ জোয়ার এসেছে, যাস না। আমরা বললাম, জোয়ার তো রোজই আসে, তাতে কী! স্নান করতে নেমে গেছি। দেখি জল তো হুহু করে ফুলে উঠছে। আরে ওটা যে জোয়ার নয়, ষাঁড়াষাঁড়ির বান, সেটা জানব কী করে? এক কাকা তো চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছেন ওরে তাড়াতাড়ি উঠে আয়। দেখি গঙ্গার দুই পাড়ে প্রচুর লোক জমে গিয়েছে। ঠিক করলাম যা আসছে আসুক, আমরা জলের উপর ভাসতে থাকব। যথাসময়ে তিনি এলেন, ভাসতে ভাসতে বালি ব্রিজের কাছে পৌঁছই। ওখান থেকে সোজা বাড়ি।
লেখাপড়ায় খুব একটা সরেস ছিলাম না। ভীষণ বাতেলা ছিল। আমাদের ওই চত্বরের সব ফলের বাগানে আমরা কয়েক জন বন্ধু মিলে অপারেশন চালাতাম। একটি ফলও থাকত না। সব সাবাড় করে দিতাম। সেই সময় পাড়ায় এ রকম দুষ্টুমি করতে পারলে খানিক নামও হত।
আমাদের একটা দল ছিল। পাড়ার লোকেরা সেভেন মাস্কেটিয়ার্স বলত। তখন ক্লাস সিক্স-সেভেন হবে। একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে। আমরা ঠিক করলাম, ষষ্ঠীর দিনটা আমরা বরানগর, আলমবাজার অঞ্চলের ঠাকুর দেখব। সপ্তমীর দিন কলকাতায় যাব। তখন বরানগরকে কলকাতা বলা হত না। কলকাতা মূলত বলা হত ধর্মতলা, মেট্রো চ্যানেল, শহিদ মিনার, ভিক্টোরিয়াকে। খানিকটা হেঁটে এবং ৪নং বাসে করে কলকাতায় পৌঁছতাম। অর্থাৎ মেট্রো চ্যানেল বা মনুমেন্টের কাছে নামতাম। ওখান থেকে ডিসাইড করতাম আগে কোন দিকটা পুজো কভার করব।
আমরা প্রথমে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউটা কভার করতাম। ওইখানে তখন বড় বড় পুজো হত। এত ঘেঁষাঘেঁষি হত না কিন্তু। শোভাবাজারে পুজো দেখতে গিয়ে পঙ্কজ রায়ের বাড়িতে ঢুঁ মারা আমাদের অবশ্যকতর্ব্য ছিল। তিনি তখন ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের গর্ব। বাঙালিরও বটে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, হ্যাঁ, পঙ্কজ রায়ের বাড়ির দরজা ছুঁয়ে এসেছি। এখানেই একটা সস্তার ভাতের হোটেল ছিল, দোকানি বাচ্চাদের দেখে হাঁকত খোকারা শোনো, এখানে দারুণ ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তোমরা তো এত ঘুরছ, খিদে পাবে। এখানে পাঁচ আনায় দারুণ খাবার পাওয়া যায়। তবে মাটিতে বসে। আমরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করতাম বলে কী রে, পাঁচ আনায় ইলিশ ভাত! চল আজ এখানেই পাতপাড়ি। কলাপাতায় এত সুন্দর করে ইলিশ আর ভাত দিত, তার এত গন্ধ, এখনও মনে পড়লে জিভে জল আসে।
সবার মতো আমার কিন্তু ঠাকুর দেখে ঢিপঢিপ প্রণাম করার অভ্যেস ছোট থেকেই ছিল না। আমি একটু পাকা গোছের ছিলাম তো। আমি ঠাকুরের মুখ, চোখ, গড়ন, দাঁড়ানোর স্টাইল, গায়ের রং দেখতাম। আর বিশেষজ্ঞের মতো আওড়াতাম: এ রঙের সঙ্গে ঠাকুরটাকে ঠিক মানায় না। বড্ড ক্যাটকেটে লাগছে। প্যান্ডেলটা ঠিক জমেনি। কিন্তু মা দুগ্গার মুখটা অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো হয়েছে। তখন সুচিত্রা সেন উঠছেন। ক্লাস নাইনটাইন হবে। সুচিত্রা সেন, উত্তমকুমার জুটি বাঁধব বাঁধব করছেন। বা অন্য কোনও ঠাকুর দেখে মনে হত, এটা দেখতে ঠিক বম্বের মীনাকুমারীর মতো। বন্ধুরাও পিছন থেকে আমার কথায় সায় দিত। বলত, চোখটা দেখেছিস, সায়রা বানু।
কফি হাউস নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে, বলি? স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রী ছন্দা, অপূর্ব সুন্দরী দেখতে! ওর সঙ্গে আলাপ হল টিউশনি পড়তে গিয়ে। বুঝতেই পারছ, ওই বয়সে তাকে নিয়ে দিনরাত স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলাম। হ্যানাত্যানা অনেক কিছু ভেবেটেবে একটা প্রেমপত্র লিখে এক দিন ওর বইয়ের মধ্যে গুঁজে দিলাম। এর ঠিক কয়েক দিন পরই ও বলল, ‘কাল এক বার কফি হাউসে আসতে পারবে?’ আরে আসতে পারব কী, এক বার বলিলেই যাইব! সে কী উত্তেজনা আমার। সারা রাত ঘুম টুটে গেল। কখন কাল হবে। যা-ই হোক, পৌঁছে দেখি কফি হাউসে কেলেঙ্কারি! সুন্দরীকে ঘিরে মৌমাছির মতো গুঞ্জন করছে আমারই জনা চারেক বন্ধু। আশ্চর্য! এরা যে সবাই এক একটি কার্তিকের মতো সুপুরুষ। আমি পৌঁছতেই কেমন জানি ওরা গুজগুজ-ফুসফুস করতে থাকল। কী ব্যাপার? বিস্ফোরণটা ঘটাল সুন্দরী নিজেই। জানা গেল, পাঁচ জনেই নাকি সুন্দরীকে প্রেমের চিঠি দিয়েছি। সবার তখন আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। ‘আমি লিখিনি, ওটা আমার অন্য বন্ধু লিখেছে’ ধাঁচের কথা বলে কেটে পড়ার ধান্দা করছি সবাই। ঠিক সেই মুহূর্তে ছন্দার সুরেলা মিষ্টি ধমকে সবাই আবার চুপচাপ বসে গেলাম যে যার জায়গায়। সবার মুখ তো লজ্জায় ন্যাতা। এই বার শুরু হল লাভ লেটার পড়া। ছন্দাই পড়ছিল। প্রথম চিঠিটা সাধনের, তার মুখটা তো বাংলার পাঁচ হয়ে গেল। দ্বিতীয়টা গোপালের। তৃতীয়টা আমার। একটা জিনিস সবাইকে অবাক করেছিল, প্রত্যেকটা চিঠির কথা কিন্তু প্রায় একই। যেমন, জোছনা-স্নিগ্ধ নিঝুম রাতে তোমার চন্দ্রের মতো মুখটা বার বার মনে ভাসছে। তাই এখন বুকে বালিশ চেপে তোমায় লিখতে বসেছি... ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন অবস্থায় মুখ দিয়ে কারও কথাই সরছিল না। ছন্দাই গুমোট ওয়েদারটাকে ফুরফুরে করে দিল। বলল, তোরা এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? প্রেম-প্রস্তাবে আবার লজ্জা কীসের? সুন্দরী বলেই তোরা আমায় ঝাড়ি মারতিস, আমি তাতে সায় দিয়েছি। আর সেই কারণেই প্রোপোজ করেছিস। ঠিক আছে। এতে অন্যায় কিছু দেখছি না। বরং আমি এতে ভীষণ ভীষণ গর্বিত। ছন্দা সেদিন সব্বাইকে কফি খাইয়েছিল।
পুজোর সময় তখনও ভিড় হত। কিন্তু কন্ট্রোল করা যেত। একটি মাত্র দড়ি দিয়ে। এখন দড়ি, বাঁশ, পুলিশ মিলেও ভিড় সামলাতে পারে না। আসলে তখন মানুষ কথা শুনত। ডান দিকে যান, বাম দিকে যান। প্রণাম করুন, ওই দিক দিয়ে বেরিয়ে যান। মাইকে অ্যানাউন্স হত, মুখেও বলা হত। আর তখন ছোটরা মান্যি করত বড়দের। এখন সেই রেসপেক্টটা দেখতে পাই না।
তার পর ম্যাচিয়োরিটি এল। ক্লাস টেন, বাড়িতে বলে দিত, ‘বেশি রাত কোরো না, সামনে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা।’ তখন বেছে বেছে ঠাকুর দেখতাম। এর কয়েক বছর পরে হত কী, পুজো আসছে শুনলে রেসপনসিবিলিটিটা বেড়ে যেত। এ বার বোধ হয় ছোটদের কিছু দিতে হবে। লজেন্স, বা চকোলেট, যা হোক কিছু। পয়সাকড়ি তো কিছুই রোজগার করি না, কী দেব? কিন্তু দিতে হয়। ওই পাড়ায় মৎস্যজীবীদের বাস ছিল, তখন আমি তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে শুরু করলাম। পড়ানোর কারণ, শুধুমাত্র গরিব ছেলেমেয়েদের পুজোর সময় উপহার দেওয়া। পুজোর সময় এই ছেলেদের নিয়েই ‘মহেশ’ নাটক করলাম। আমি নিজে অভিনয় করিনি বটে, পরিচালনাটা আমিই করেছিলাম। প্রচুর বাহবা কুড়িয়ে ছিলাম। আমার ছোট বোন ‘আমিনা’র পার্টটা করেছিল। আর তখন থেকেই থিয়েটারের পোকাটা আবারও নড়তে শুরু করল। জমাট বাঁধল।
নান্দীকারে আমার থিয়েটার জীবন শুরু। কলেজে পড়াকালীন থিয়েটারটাকে সিরিয়াসলি নিই। এখানে অনেকের সঙ্গে কাজ করি। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেয়া চক্রবর্তী, বিভাস চক্রবর্তী, অজয়দা, অশোক গাঙ্গুলি। কোনও এক কারণে আমরা আবার নান্দীকার থেকে বেরিয়ে যাই। বেরিয়ে গিয়ে থিয়েটার ওয়ার্কশপ তৈরি করি। ডিরেক্টর ছিলাম আমি। প্রথম নাটক ‘ছায়া আলো’। দারুণ নাম করে আমাদের দল। ব্যক্তিগত ভাবে আমিও প্রচারের আলোয় আসি। তার পর ‘মঞ্জরী আমি মঞ্জরী’ নাটকে আমার অভিনয় দেখে তপন সিংহ এক দিন বললেন, ‘চিন্ময়, আমি তোমাকে নিয়ে একটা সিনেমার কথা ভেবেছি, তুমি করবে?’ আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়। ‘পরশু দেখা কোরো, স্ক্রিপ্ট রেডি, হাতে হাতে দিয়ে দেব।’ যথাসময়ে গেলাম তপনদার কাছে। তাঁর ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে আমায় একটা বড় চরিত্রে কাজ দেন। সেই আমার ছবিতে ব্রেক।
এর পর একের পর এক ছবিতে বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। জীবন শুরু করেছিলাম ৫০ টাকায়, এখন চলতা রহা।
আমার জীবনের প্রেমের যোগ এক বারই এসেছিল। জুঁইয়ের সঙ্গে। ওর সঙ্গে প্রেমটা একটা অদ্ভুত ভাবে ঘটে গিয়েছিল। ‘ননীগোপালের বিয়ে’ ছবির শুটিং চলছে। এর আগে ‘বালিকা বধূ’-তে জুঁইয়ের প্রথম অভিনয় দেখেছি। ‘বালিকা বধূ’তে অভিনয় দেখে আমি তো একেবারে ফিদা! উপযুক্ত সময়-সুযোগ খুঁজছিলাম, কী ভাবে, কখন জুঁইয়ের সঙ্গে আলাপ করা যায়! একটা দারুণ সুযোগ পেয়েও গেলাম এক দিন। ‘ননীগোপালের বিয়ে’ শুটিংয়ের এক ফাঁকে এক দিন সরাসরি মেক-আপ রুমে গিয়ে বলে ফেললাম, তুমি কি আমার হবে? জুঁই শুধু মুচকি হেসেছিল। আহা রে! আমি তো গলে ফ্যান! বুঝে গেলাম আমাকে আর আটকায় কে? প্রেমে পড়লে বেশি দিন ফেলে রাখতে নেই। এটা আমি মনে করি। তাই সো-ও-জা ছাদনাতলায়।
‘গৃহপ্রবেশ’ বলে একটা থিয়েটার হয়েছিল। তাতে দুর্গাপুজো সম্বন্ধে একটা মজার ডায়লগ ছিল। সেটাতে আমি চাকরের রোলে পার্ট করেছিলাম। পরে ওটা ছবিও হয়েছিল। ছবিতে ভানুদা আমার রোলটা করেছিলেন। নাটকটা জ্ঞানেশদার ডিরেকশনে হয়েছিল। পাড়ার পুজো। রুস্তমরা আস্তে আস্তে কমিটিতে অনুপ্রবেশ করছে। আর ভদ্রলোকেরা ধীরে ধীরে কমিটি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রুস্তমরা জোর করে, বেশি বেশি চাঁদা আদায় করছে। নাটকে এ রকম একটা জায়গা ছিল। রুস্তমরা এসে বলছে ‘আমাদের পুজোটা এ বার সুবর্ণজয়ন্তী হচ্ছে কাকা, আর তিনশো টাকায় হবে না। হাজার চাই।’ আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। বাবু ভিতরের ঘরে ছিলেন। আমাকে বললেন, ‘দেখে তো, কে এসেছে, চাঁদা নাকি কী বলছে। কিছু দিয়ে বিদেয় দে।’ আমি রুস্তমদের বললাম, ভাই তোমরা যে হাজার চাইছ, তোমাগো প্রতিমার থিম কী? এখন থিমটিম হচ্ছে শুনতাছি। বললে, ‘হ্যাঁ, দারুণ প্রতিমা হচ্ছে স্যর, সরস্বতী হচ্ছে বিউলির ডালের বুঝলেন, বিউলির সঙ্গে গঁদের আঠা মিশিয়ে যা চকচক করবে না, দেখবেন স্যর। লক্ষ্মী হচ্ছে ছোলার ডালের। এত সুন্দর করছে না, দেখে আসবেন স্যর। আর মা দুগ্গা করা হচ্ছে সমস্ত রকমের মশলা দিয়ে। এলাচ দিয়ে চোখ, বড় লঙ্কা দিয়ে হাত। যত রকমের ডাল আছে মিক্সচার করে গণেশ। কার্তিক হচ্ছে মুসুরির ডালের। আর অসুর এক ধরনের জমাট চিনি পাওয়া যায় না, তা দিয়ে করা হয়েছে, স্যর। দেখে আসবেন মশলা-ডালের ঠাকুর।’ আমি বললাম, তোমাগো এটা হল গিয়া থিম। আমি একটা তোমাদের খরচা বাঁচাইয়া দিতাছি। ঠাকুরগো বিসর্জন দিয়ো না। ‘মানে? ঠাকুর লরিতে উঠবে, সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। ভুর ভুর করে সুগন্ধ বেরোবে।’ সুগন্ধ বের হতে হবে না, এতে অনেক খরচ কমে যাবে। একটা কড়াইতে ভাল কইরা জল তেল দিয়া মা দুগ্গারে আর সবাইকে চুবাইয়া দিয়ো। অর্থাৎ আমাগো মাকে ওই কড়াইয়ে বিসর্জন দিবা। আর বড় একটা খুন্তি জোগাড় করো। খিচুড়ি বানাইয়া ফেলো। তার বলল, ‘কথাটা তো মন্দ বলেননি, স্যর। এটা হয়?’ হ্যাঁ, কেন হবে না? এখন কত চাঁদা নেবে বলো? ‘ওই তিনশো টাকাই দিন, স্যর’! বাবু বেরিয়ে এসে বললেন (হারধনদা রোলটা করতেন), ‘বাঃ, ভাল কায়দা করে তাড়ালি তো। তোর বুদ্ধি আছে, দেখবি খিচুড়ি খাওয়ার পর তোকে না আবার তাড়া করে?’
আমি খুব আড্ডা-প্রিয় মানুষ জানো। অনেক আগে রবি ঘোষের বাড়িতে আড্ডা মারতে যেতাম। সেখানে জহরদা, ভানুদা, রবিদা, আমি সবাই জুটতাম। নানান বিষয় নিয়ে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলত। ওই আড্ডা থেকে আমি একটা জিনিস রিয়েলাইজ করেছিলাম। জহরদা, ভানুদা, রবিদা, সবার মনে একটা প্রায়-একই রকম খেদ ছিল কমেডি ছাড়া আমরা অন্য চরিত্রে অভিনয় করছি না কেন? আমরা সিরিয়াস চরিত্রে কি বেমানান? সত্যি সত্যি যদি তুলসীদার ‘পরশ পাথর’-এর মতো একটা চরিত্র পাওয়া যেত, করে দেখিয়ে দিতাম। অভিনয় কাকে বলে। অবশ্য এটা আমারও যে মনে হত না, তা নয়।
তখন পুজোর একটা আলাদা চার্ম ছিল। নবমীর পর চলে যাওয়ার বাজনা বেজে উঠত মনে, দশমীর দিন কান্না, মনখারাপ হয়ে যেত। তখন সিঁদুর খেলা এনজয় করতাম, এখন সেই দিনগুলো চলে গেছে। এখনকার বউদিরা সিঁদুর খেলার জন্য সাজে, কখন টিভি চ্যানেলে আসবে ভেবে। এখন ব্যাপারটা পুরো মেকানিজম হয়ে গেছে। তখন যে সামনে আসত তাকেই সিঁদুর মাখানো হত। এখন তো বেছে বেছে দেওয়া হয়। ভক্তিভাব আর নেই।
এখন আমার আর পুজো নেই। তবে ফিতে কাটতেটাটতে যেতে হয়। যাতায়াতের খরচটা দিয়ে নিয়ে যায়। সবাই বলে, চিন্ময় রায় কম পয়সা নেয়, চলো ওঁর কাছেই যাই। ওখানে গিয়ে যখন দেখি আমার থেকে বেশি বয়সী পুরুষমহিলারা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন, তখন খুব কষ্ট হয়। অন্য দিকে আবার গর্বও হয়, যখন দেখি মায়ের উদ্বোধনের জন্য আমায় ডাকা হয়েছে।
এ বছর আমার স্ত্রী, সবার প্রিয় অভিনেত্রী জুঁইকে হারিয়েছি। ফলে এ বারের পুজোটা আমার কাছে বর্ণহীন, ম্যাড়মেড়ে। সকালটা আমার কোনও ভাবে কেটে যায়, কিন্তু সন্ধেবেলাটা খুব খারাপ কাটে। বার বার জুঁইয়ের কথা মনে পড়ে। পুজো আসছে। কী হবে জানি না। বহু বছর পর এ বার পুজোয় আমার সঙ্গে আর জুঁই থাকবে না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.