ধরা পড়েছি আমি
য়না বললেই মনে পড়ে নিজের মুখের ছায়া। ওই এক টুকরো কাচে সবাই বাঁধা পড়ে রয়েছে সারা জীবন। ওই আয়নাটি দেখে যেন মনটা খুশি হয়, তার জন্য আজ আমলা, কাল পেস্তাবাটা, মাজাঘষার কত রকমসকম। কাত হয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাইসেপস ফোলানো, মাথায় ঘোমটা টেনে ভীরু হাসি, সব কিছু ধরা পড়ে যায় আয়নাতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যে দিনগুলো মনটা খুশি হয় না, সে দিনগুলোয় নিশ্চিত গভীর নিম্নচাপ।
নিজের মধ্যে থেকে বেরোনো যায় তখন, যখন আয়নায় চোখ রেখে দেখা যায় আর এক জনের মুখ। কিংবা আলতা-পরা পা দু’খানি। আর জীবন এমনই অসহ্য যে সেই দিব্য দৃশ্য দেখা যখন যায়, তখন মায়ের চলে যাওয়ার সময়। বিসর্জনের সব স্ত্রী-আচারের মধ্যে আয়নায় দেবীর মুখটি দেখার নিয়মখানি সবচেয়ে মারাত্মক, ওটা যেন তৈরিই হয়েছিল কাঁদিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য। যখন নিজেকে না দেখে দেখতে পাই তোমার থরথর ছায়া, তখনই তুমি চলে যাচ্ছ মা? চার দিন ধরে ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি’ করে গলা চিরে ফেলার পর দশকর্মভাণ্ডারের টিন-বাঁধানো আয়নার ছোট্ট ফ্রেমের মধ্যে তুমি ধরা দাও, আমরা বুঝি কেন তোমার নাম ‘অপরূপা’, কেন তুমি সর্বদাই বিজয়িনী। ঠাকুর দেখা যতই হোক, দেবীর দর্শন হয় ওই আয়নার কাচে। তার পরেই নানা লোকের কাঁধে চেপে তুমি চলে যাও, আমাদের ফাঁকা মণ্ডপে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকতে হয়। বিষাদযোগ দিয়েই ঈশ্বরের সন্ধান শুরু, তা কি এমন করে বুঝিয়ে দিতে হয়?
সন্ন্যাসীদের নাকি আয়না দেখতে নেই। কথাটা শুনলে মনে হয়, ঘোড়ার আগে রাখা হল গাড়িটা। আয়না দেখা বন্ধ যদি না হয়ে গিয়েই থাকে, তা হলে সন্ন্যাসী হলেন কী করে মশাই? এক খণ্ড কাচ যদি সামনে থাকে, তার ভিতর দিয়ে বিশ্বচরাচর দেখা যাবে। কিন্তু কাচের পিছনে একটু পারা যদি কেউ লাগিয়ে দেয়, অমনি সামনে থাকবে শুধু নিজের চেহারাখানি।
বাকি সব তখন ব্যাকগ্রাউন্ড। গোটা ব্রহ্মাণ্ডটাই চালচিত্র কেবল, আমি মাঝে আছি বলে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজেকে নিয়ে নিজের যে মুগ্ধতা আমাদের মধ্যে কাজ করে, আয়না রোজ তাকে একটু জল দেয়, তাকে সজীব রাখে। একটা অফিসে লিফট ভারী আস্তে ওঠানামা করত, রোজ লোকে রেগেমেগে অভিযোগ করত। ‘কে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে মশাই?’ ম্যানেজারবাবু লিফটের পাশে একটি বড় আয়না টাঙিয়ে দিলেন। দেখা গেল, অভিযোগ আর প্রায় আসে না। অপেক্ষার সময় কমেনি, কিন্তু সেটা আর অত অসহ্য মনে হচ্ছে না। নিজেকে দেখতে দেখতে সময় দিব্যি কেটে যাচ্ছে।
আগেকার দিনে জমিদারবাড়িতে আয়না থাকত বেলজিয়ান গ্লাসের, সে সব দেখার মতো জিনিস। সম্প্রতি মহীশূরের রাজপ্রাসাদেও তেমন বেশ কিছু আয়না দেখে আসা গেল। মস্ত মস্ত দেওয়াল জোড়া আয়না, তার চার দিকে দারুণ বাহারি ফ্রেম, আয়নার কাচের উপরেই নানা নকশা তোলা। এ সব আয়না চেহারার মাপে নয়, ইগো’র মাপে। রাজারাজড়ার প্রতিচ্ছবি পড়ার যোগ্য হতে হবে না আয়নাকে? গরিবগুর্বোর আয়নার মাপে জমিদারের আয়না হতে পারে কখনও? ইগোর সঙ্গে আয়নার যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে, মহাভারতে পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের প্রাসাদে দুর্যোধনের নাকাল হওয়ার সংবাদ পড়লে তা বেশ টের পাওয়া যায়। তিনি যে স্ফটিকের মেঝেকে জল ভেবে কাপড় গুটিয়ে নামতে গেলেন, আবার জলকে শুকনো ডাঙা ভেবে পড়ে ডুবে গিয়ে নাকাল হলেন, এর মধ্যে কোথাও একটা প্রতিবিম্বের খেলা ছিল নিশ্চয়ই। ময়দানবের কৌশলে আলোর প্রতিফলন এমন বিভ্রম ঘটিয়েছিল। দুর্যোধনের ইগো সে দিন যে আঘাত খেয়েছিল, কুরুক্ষেত্রের জন্য এগারো অক্ষৌহিণী সেনা জোগাড় করার সূচনা হয়েছিল তা থেকেই।
এখন আয়না দিয়ে বিভ্রম ঘটানো হয় বাহারি জিনিসপত্রের শোরুমে। দেওয়ালের শেষে লাগানো থাকে কাচ, যাতে মনে হয় দোকান তার সব সম্ভার নিয়ে আরও অনেকখানি বিস্তৃত রয়েছে ভিতর দিকে। তার ঘরের মাপ, জিনিসের স্টক, সবই অনেকখানি বেশি মনে হয়। আলোর উজ্জ্বলতাও দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এই সব দোকানের আয়নায় যে কাপড়ের যেমন রং-উজ্জ্বলতা মনে হয়, আসলটা অতটা না-ও হতে পারে। দোকানে যা মনে হয়েছিল উজ্জ্বল ঘন লাল, বাড়ি এসে দেখা গেল সেটাই ম্যাটমেটে মেরুন। সাবধানী লোকজন তাই পছন্দের শাড়ি-জামা এক বার বাইরে এনে দিনের আলোয় পরখ করে নেন।
আয়না ঠকাতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। আবার আয়নাতেই আসল কথা জানা যাবে, এই প্রত্যয়ও। রূপকথায় সত্যি কথা বলে আয়না। ‘মিরর মিরর অন দ্য ওয়াল, হু ইজ দ্য ফেয়ারেস্ট অব দেম অল,’ এ প্রশ্নটা স্নোহোয়াইট গল্পের সেই হিংসুটে রানি বলেছিল বটে, কিন্তু আমরাও কি মাঝে মাঝেই আয়নার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্নটা করি না? জগতে সেরার বড়াই না থাক, যে জায়গাটা আমার সেখানে আমিই আছি, নাকি আর কেউ এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে, নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। যখন আয়না আর কাউকে দেখায়, তখন তাকে নির্বাসন দিতে কতই না কাঠখড় পোড়াতে হয়।
বাথরুমের আয়নায় দ্রুত দাড়ি কাটা থেকে লম্বা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ চুলে নানা কারিকুরি আয়না সব কাজের সঙ্গী। এখন নানা জিনিসের সঙ্গে ছোট্ট এক টুকরো আয়না দেওয়া হয় লিপস্টিকের কৌটো, পাউডারের গোল কেস, গয়নার বাক্স, এমন কত কী। চট করে নিজের কাজলটা বুলিয়ে নিতে, কিংবা লিপস্টিক মেরামত করতে এগুলো কাজে লাগে। গাড়ির আয়নাতেও সেই কাজ সারা যায়। অটোর দু’পাশে লাগানো রেয়ার ভিউ মিররে দ্রুত নিজের সাজসজ্জা চেক করে নেন অনেকে। নিজেকে যত বেশি সদা-প্রস্তুত, সদা-ফিটফাট রাখার চাপ বাড়ছে, আয়না তত আমাদের কাছে প্রতি মুহূর্তের প্রয়োজন হয়ে উঠছে। একটা ছবি ছেপেছিল একটি ম্যাগাজিনে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন এবং তাঁর সঙ্গী আরও দুই রাষ্ট্রনায়ক, তিন জনই একসঙ্গে একটি বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই ঠিক করছেন। সঙ্গের টিপ্পনী ছিল, তিন জনে যাচ্ছিলেন হোয়াইট হাউসের বাইরের বাগানে প্রেস কনফারেন্স করতে, এমন সময়ে কেউ বলেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, ইয়োর টাই।’ অমনি তিন প্রেসিডেন্টই একসঙ্গে নিজের টাই স্পর্শ করেন আয়নায় তাঁদের সামান্য ভ্রূ-কুঞ্চিত, সিরিয়াস মুখের ছবি। জীবনের অন্য সময়ে তিন জন এক সঙ্গে এক কাজ হয়তো কমই করেছেন, আয়নার সামনে তিনটি পুরুষ একই রকম।
আয়নার সামনে যে আর দাঁড়ায় না, হয় সে জীবন থেকেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, নইলে নিজের বাইরে বেরিয়ে কোনও অনন্ত জীবনের সন্ধান পেয়েছে। ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’ সে সাড়া পাওয়া খুব সহজ নয়, নিজের বুক নিজের সুখদুঃখে ভারী হয়ে থাকে সব সময়ে, তাকে সরিয়ে এক চিলতেও জায়গা করার সাধ্য ক’জনের? তবু রাস্তার জমা জলে যেমন আকাশের ছায়া পড়ে, তেমনই আমাদের ঘোলা জলের ডোবা জীবনযাপনে কখনও স্পর্শ পাওয়া যায়
অনন্ত সৌন্দর্য, অসীম শক্তির। তখন বিদায়ের বরণডালার ধান-দুর্বা-মিষ্টি-জল-পানসুপুরির পাশে রাখা টিনের ফ্রেমে বাঁধানো আয়নাটিতে ছায়া পড়ে দুটি হলুদবরন আলতা-আঁকা পায়ের। ত্রিনয়নার দৃপ্ত কিন্তু স্নেহময় মুখখানির। প্রতিবিম্ব বলে যায়, ‘আর একটু তাকিয়ে দ্যাখ দেখি মা, যদি নিজেকে দেখতে পাস।’

শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.