আগুন-আগ্রাস, জলপটির স্নিগ্ধতা
ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে খুব জলের কষ্ট। বছর আষ্টেক বয়স অবধি কর্পোরেশনের কলে জলটা তা-ও আসত, তার পর বাড়িওয়ালা কী সব কায়দা করে সেটিও বন্ধ করে দিল। অগত্যা জীবন ভারী নির্ভর হয়ে পড়ল, ভারীর ওপর। খরচ করার জন্য দেদার জল পেতাম না বলেই বোধ হয়, আমি জল খুব ভালবাসি। অবশ্য এই ভালবাসার পেছনে আমার দিদির অবদান মারাত্মক। আমরা যখন দুজনেই বদমাইশি করার মতো ছোট, তখন ও যদি জল চাইত আর গ্লাসখানি এগিয়ে দিতে যদি একটু দেরি হত, তখনই ও একটা গান গাইত, ‘আমায় জল দিলে না, জল দিলে না... পরজন্মে চাচাচাচা, চাতক পাখি হবে’। চাতক পাখি যার কিনা গলায় ফুটো আছে, তাই সে উল্টো হয়ে ওড়ে আর বছরের কোনও একটা নির্দিষ্ট দিনে তার গলার ফুটোয় জল পড়ে, সে ওই জল খেয়ে বেঁচে থাকে এবং সারা বছর জল খেতে পায় না, সেই চাতক পাখি হওয়ার কোপটি নিদান হাঁকার মতো আমারই ওপরে এসে পড়ত। আমি আকুলিবিকুলি, দিদিকে জল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢকঢক জল নিজেও খেয়ে নিতাম, যদি আর জন্মে না পাই? আর দিদি বড় হওয়ার অ্যাডভান্টেজ ফেডেরার, নাদাল কিংবা জকোভিচের মতোই উপভোগ করত।
তবে, জ্বালা আমার এখানেই শেষ নয়। জেঠিমারে রে করে উঠত, যেই দেখত ভাতের থালা এক পাশে সরিয়ে থালার পাশের বিন্দু বিন্দু জল দিয়ে নকশা কিংবা আমাদের ছোট নদী তৈরি করার চেষ্টা করছি, একটা জলের ধারাকে আঙুল দিয়ে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার খেলায় মেতে উঠেছি। জলের দাগ কাটলে নাকি বাপের ঋণ হয়। কিছুই বুঝতাম না, কেবল বুঝতাম জল আমায় ভাসিয়ে রাখে। আমি যখন ক্লাস নাইন, বন্ধুরা সবাই সুন্দরবন বেড়াতে গেল স্কুল থেকে। মা যেতে দিল না কিছুতেই। যদি লঞ্চ ডুবে যায় কিংবা আমি হইহইয়ের বেখেয়ালে লঞ্চ থেকে পড়ে যাই? কেন মা, যাই না!
No এবং Big No. কালীপুজোয় নৌকো চেপে আমাদের দেশের বাড়ি যেতে হয়। গঙ্গার জলে হাত দেওয়া বারণ, গঙ্গায় চান বারণ। ভাসানের সময় ঘাটে যাওয়া বারণ। কেন মা, যাই না! না, আর কিছুতেই না।
তবু আমার ভাগের জল আমি চুরি করে নিয়েছি। আমাদের বাড়িতে থাকত রনোদাদা আমাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসত। বর্ষাকালে স্কুল থেকে ফেরার সময় মা রিকশা-ভাড়া দিয়ে দিত। আমি আর দিদি রনোদাদার কাছে অনুনয়-বিনয় করে আদায় করতাম হাঁটু অবধি জল-ছপাছপ বাড়ি ফেরা। আর রিকশা ভাড়া দিয়ে? গরম গরম ভুট্টা। ইন শর্ট আমার রাংতা-দিন।
আমি অহরহ জলের স্বপ্ন দেখি। এখনও। খুব জল, মানে এ দিক থেকে ও দিক, গোটা স্বপ্ন জুড়ে জল। কেউ যদি বুকজলে সাঁতার কাটে কিংবা এক বার ডোবে এক বার ওঠে যেমন আনন্দ হয়, আমারও ঠিক তেমনটা হয়। খলবল-খলবল, বুকবুকবুকবুক, টুবটুব ছোট্ট ডুব। আর সকালে উঠে ঠিক বুঝতে পারি সোঁদা সোঁদা গন্ধটা কোত্থেকে পাচ্ছি। কিন্তু যখন শুনলাম স্বপ্ন কাটাছেঁড়া করে নাকি জানা গিয়েছে, জলের স্বপ্ন মানে মনে হতাশার ইশারা, বড়ই ভেঙে পড়েছিলাম। আমার জন্য নয়, জলের জন্য। এমন মিছে একটা তকমা তাকে না দিলেই চলছিল না! আর ইহুদি বিশ্বাসে জল যে সৃষ্টির প্রতীক, তার বেলা?
আমায় যে যত জল থেকে দূরে সরাতে চেয়েছে আমি জল তত ভালবেসেছি। কেন? জলের ছলছলানো বাতিক আমার ভাল লাগে? জল জানে সে অপরিহার্য, আর তাই তার অ্যাবসলিউট রেলা, সেটা আমার ভাল লাগে? যে, দ্যাখো বাবা, পৃথিবীতে যেখানে যে যত বড়ই কাপ্তেন হোক, আমায় ছাড়া চলবে না। না কি তার কিছুতে কিছু যায় আসে না, তাপ-উত্তাপ বিশেষ নেই। বরফ করে রাখো থাকব, আবার বাষ্পে উড়িয়ে দাও তো ভি থাকব। আমায় এ পাত্রে রাখলে থাকব, ও পাত্রে রাখলেও থাকব। এক ঢিল তরঙ্গ তুললে আমি লাস্যময়ী, আবার এক ঝড় ঢেউ তুললে আমি ভয়ঙ্কর। আমার চেয়ে শান্তও কেউ নেই, আমার চেয়ে ভয়ঙ্করও কেউ নেই। আমিই আগুন-আগ্রাস, আমি জলপটির স্নিগ্ধতা। এই যে কোনও কলার না তুলে তার অনিবার্য উপস্থিতি এটা এক এক সময় অসহ্য ঠেকে। মনে হয় আকারহীনতা, অ্যাবসলিউট লাইটনেস, বেরং, স্বচ্ছতা এই সব হাবিজাবি ধর্মের কারণে সে জিতে গেল, মানে জিতেই গেল। অথচ এগুলো নিয়ে গর্ব করা চলে কি? ঈশ্বর নয়, মহাশূন্য নয়, ঘষে যাওয়া পুরনো চাবি নয় কিংবা যৌবনবতীর রাত্রিবাস নয় অতএব এ সব ধর্ম নিয়ে হবেটা কী? অথচ চরম Power.
আসলে, জলের কাছে অনেক পাওয়ার। তার ধারণক্ষমতাই চমকে দেওয়ার মতো। জলে যা যা তলিয়ে যায়, আমরা তাকে সর্বনাশ আখ্যা দিয়েছি। কিন্তু আদত ধরিত্রী বোধ হয় জলেরই তলায়। দশমীর দিন সিঁদুর ল্যাপ্টানো, সন্দেশমাখা টুলটুলে মা-দুগ্গার মুখখানা যখন তলিয়ে তলিয়ে যেতে থাকে চোখের সামনে, তখন কেমন মনে হয় শেষ তো বড় ভয়ঙ্কর, বড় অসহায়, বড় শূন্যতার। জলে যেন জীবনের সব আড়ম্বর শেষ। অথচ মাটির মূর্তি তো, সেটা খেয়ালই থাকে না। জলের কাছে মাথায় হাত ঠেকিয়ে কী বলি? হে মা দুগ্গা আবার এসো? আর তাই সেই জল থেকেই উঠে আসে নতুন দুগ্গার আকাঙ্ক্ষা। এই যে সমুদ্রে কিছু হারালে সবাই বলে, সমুদ্র কিছু রাখে না, ফিরিয়ে দেয় বোতল, ওড়না, চশমা, এমনকী ডেডবডি অবধি! ফিরিয়ে নিশ্চয়ই দেয়, কেবল ছিবড়েটুকু। পইতে তুলে শাপশাপান্ত করতে ইচ্ছে করে না? এত আগ্রাসী তুই? এত খিদে, এত বড় হাঁ তোর? আগুন ছাড়িস না, মাটি ছাড়িস না, শ্বাস ছাড়িস না এ তো হরণ। না কি উহাই ধারণ? ওই বডির প্রাণ ধারণ করেছে সে? আমাদেরই কি দেখার ভুল? হয়তো বা।
কেবল জানি, শেষ নাভিটুকু নাকি জলে দিতে হয়। ওই জলে গচ্ছিত থাকে প্রাণের, প্রিয়জনের শেষ চিহ্নটুকু। আগুন যা শেষ করতে পারে না, তা-ই জল নিশ্চিন্তে ধারণ করে রাখে। ধারণ করে রাখে আমার ছেলেবেলার অঙ্কখাতার পাতা দিয়ে তৈরি আধ-রাস্তা পেরোনো ভিজে ল্যাতপ্যাতে মৃত জলযানটা, লুকিয়ে রাখে এক বিন-লাদেন আক্রোশ, বুকে করে রাখে আস্ত একটা হিমালয়, লাভা-টগবগ আগ্নেয়গিরি, টাইটানিক-সর্বনাশ হিমবাহসকল, ধরে রাখে দুগ্গার চুরি করা হার, যা অপু দুগ্গা মারা যাওয়ার পর পুকুরের নিশ্চিন্ততায় জলাঞ্জলি দেয়, ভাসিয়ে রাখে সদ্যোজাত অযাচিত সন্তানদের, গিলে নেয় সাপে-কাটার বিষ, আশ্রয় দেয় মুখুজ্জে বাড়ির কুলটাকে, ধরে রাখে এক আকাশ মুক্তি।
আমি যখন বছর ছয়েকের, তখন বাবা আমায় একটা বিশাল নীল দেখিয়ে বলেছিল, বল তো ওটা কী? আকাশ-নীল আর বিশাল-নীল গুলিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘আকাশ!’ বাবা বলল, ‘দূর বোকা, ওটা সমুদ্র।’
আর তাই বোধ হয় যখন চিৎ-সাঁতার শিখেছিলাম, তখন চোখ খুললে নিজেকে মা-দুগ্গা মনে হত।

শিল্পী: উপল সেনগুপ্ত



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.