|
|
|
|
আমি পদ্ম |
দিঘির কালো জলে টুকরো আকাশ, আর তারই ফাঁকে লজ্জায় ঢাকা পদ্ম। সে জানে প্রেম
হরণ করে,
আবার মুগ্ধও। আর তাই গুলিয়ে যায় সমস্তটা। তিলোত্তমা মজুমদার |
ঝিরিঝিরি বাতাস ছিল, আর রবিকর। দিঘির কালো দলে জলপোকাদের নড়াচড়া জলতলকে আয়না হতে দিচ্ছিল না। ওই যে তাদের ডুব আর চুব। ওই যে মৎস্যকুলের কৌতূহলী উঁকিঝুঁকি, তাতে জলের ওপর নিরন্তর ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ, যেন কোনও এক সুখের পুলকে শিহর জাগিছে হৃদয় মনে। আর আকাশ নিজেকে দেখবে বলে যেই ঝুঁকছে, অমনি ভেঙে খানখান। নিজেকে যা দেখল সে, তা কেবল তার মেঘের জামা। বাইরের আবরণ ছাড়া বাকি সব মিশে গিয়েছে জলের সঙ্গে। ভালবেসে, ভেঙে ভেঙে। ভালবাসবে, আর ভাঙবে না, তা কি হয়! হয়েছে কোথাও? কোনও দিন?
ঢেউ তোলা দিঘির কালো জলে ওই টুকরো টুকরো আকাশ তারই ফাঁকে আমি শতকোটি হয়ে ফুটলাম। আমি পদ্ম।
কোন মুহূর্তের আমিত্বে আমি পরিপূর্ণ? জানি না। নিজেকে জানা কি ফুরায় কখনও? ওই সব ভাসমান সবুজ মসৃণ পাতা, এই সুডৌল মৃণাল, সেই আমার প্রস্ফুটিত হওয়ার আগে অপরূপ কমলকলিকা, যে দিকে দেখি, সব দেখি পূর্ণতার মায়ায়। অবশেষে একটি একটি করে দল মেলেছি, আর সমগ্রের সংজ্ঞা নতুনতর অর্থ নিয়ে ধরা দিয়েছে। সারা বিশ্বের শত-কোটি মুগ্ধ নয়নের দৃষ্টিপাতে লজ্জিত হতে হতে, মূর্চ্ছিত হতে হতে, বিলোল হতে হতে আমি ভেবেছি আমি কে? আমি কী? আমি কেমন? নিজের থেকে নিজেই যে আর চোখ ফেরাতে পারি না।
|
|
আমার শরীরের গন্ধ কখন চলে গিয়েছে যোজন পথ বেয়ে! তাতেই আকুল হয়ে প্রথম ছুটে এল এক ছোট্ট সুন্দর প্রাণী। ভোমরা। ছোট্ট ডানা ছড়িয়ে বলল, ‘কী সুন্দর তুমি! কী অসামান্য মাতাল করা সৌগন্ধ তোমার! শতদলবতী, তুমি আমার!’ প্রেমের প্রথম সম্ভাষণ। আমি মোহিত হলাম। বললাম, ‘এস।’ সে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
যেমন করে আমার বুকে বৃষ্টি নেমেছিল, যেমন করে চুমু দিয়েছিল সমীর, এ তেমন নয় আমি বুঝলাম। ভ্রমর পরম সুখে আমার কোরকবক্ষ দংশন করল, আমার যন্ত্রণার খবর নিল না। বিপুল তৃষায় আমার মধুরস শোষণ করল। আমার ইচ্ছার অনুমোদন প্রার্থনাও করল না। আমি বুঝলাম প্রেম যাতনাময়। প্রেম হরণকারী। লুণ্ঠক। আমি একই সঙ্গে হর্ষ ও বিষাদ লাভ করলাম। কোরকে দংশনচিহ্ন দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ ও সশঙ্ক হলাম। আমারই মধু পান করে, আমারই রেণু-রঞ্জিত হয়ে তৃপ্ত ভ্রমর উড়ে গেল। বলল, ‘তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি আবার আসব।’ কই, সে তো জানতে চাইল না, আমার সুখের খবর! আমি বুঝলাম, প্রেম স্বার্থপর! আমার দলমণ্ডলের লালিমা, আমার পাগল করণ সৌরভ, আমার তনুমন্থনলব্ধ মধুভাণ্ড এ কি তবে আমারই নয়? আকাশ, তুমি কি জানো? বাতাস, বলতে পারো তুমি? ও জল! আমি নিজেকে কোথায় নিবেদন করব?
কেউ কিছু বলার আগেই তাঁর মধুর গম্ভীর স্বর ঘোষণা করল, ‘এস, আমার নাভিদেশে অধিষ্ঠিতা হও।’ তিনি বিষ্ণু। ত্রিদেবের অন্যতম। তিনি যা চান, তা পান। আমি তাঁর নাভিপদ্ম হলাম। এত সুখ হল তাঁর, এত আনন্দ, আমাকেই তিনি যোনি করে তুললেন, আমারই অঙ্গে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা উদ্ভাবিত হলেন এবং হস্তে ধারণ করলেন আমাকেই। আমি ব্যবহৃত ও প্রদর্শিত হলাম। কত বার! কত রকম ভাবে! কেউ আমার পাপড়ি ছিঁড়ে দুই আঁখি গড়লেন। কেউ ভাবলেন, আমার পা দুটো পদ্মের পাপড়ির মতো হলে মন্দ হয় না! অমনি আমি তাঁর পায়ে পড়লাম। কেউ আমাকে সুখাসন করলেন। গলে পরলেন মালিকায় গেঁথে। কারও মনে ধরল আমার মৃণাল। কেটেকুটে ভুজদ্বয়ে সংস্থাপন করলেন। দেবকুলে অতি গৌরবে আমি বরণীয়া হয়ে উঠলেম।
এক দিন এক সর্প এল দিঘির জলে। আমার প্রসারিত পত্রপুটে বসে রোদ পোহাচ্ছিল একটি সোনাব্যাঙ, তাকে গিলে খেল। ক্ষুধাপূরণ হলে আমার দিকে দেখল মুগ্ধ সর্পচোখে। কিচ্ছুটি বলল না। আমার মৃণাল জড়িয়ে ঘুমোল। এক ভালমানুষের ছা রোজ আসত ডিঙি বেয়ে। বকের সারি দেখে খলখল করে হাসত আর হাততালি দিত খুশিতে। এক খাবলে মাছ ধরে বলত, ‘তুই দুষ্টু!’ তার পর ছুড়ে দিত জলে। মারত না। পদ্মবীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যেত বৃদ্ধা পিতামহীর জন্য। ডিঙি থেকে ঝুঁকে আমার বুকের গন্ধ নিত সে, আর ফিসফিসিয়ে বলত, ‘মা দুগ্গার বুকে ঠিক এমন গন্ধ। আমি জানি।’ আমি তার দু’হাত ভরে দিতাম ফলে। সে দিন সে ঝুঁকল আমার বুকে আর সুখনিদ্রা ব্যাহত হওয়া সাপ তাকে ছোবল মারল।
এক মুহূর্তের জন্য সে বড় অবিশ্বাসে, বড় বিস্ময়ে চাইল আমার দিকে, যেন আমিই আঘাত করেছি। তার পর যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল।
উদ্ধত ফণভৃৎকে ঘৃণা করলাম সেই ক্ষণে! বললাম, ‘এ কী করলে! জানো, ওর মা নেই।’
সাপ বলল, ‘আমার কাজ আমি করেছি।’ বললাম, ‘ফিরে নাও সব বিষ।’ সাপ শর্ত দিল, যদি তার হই, তবে নেবে ফিরিয়ে। ঘৃণার সঙ্গে মিলিত হলাম সাপে। সে আমাকে মাথায় তুলে নিল। প্রেমহীন সমাদরের কী যন্ত্রণা, আমি বুঝলাম।
আজও যখন হাটে বিকোই, রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে অথবা শ্বেতকমল রূপে মৃতদেহের বুকের ওপর শায়িত, ভাবি, আমি কে? আমি কী? আমি কি আমারই ইচ্ছা? না কি, আসলে ইচ্ছা বলে কিছু নেই। এই মহাজগৎ আমার অধীশ্বর। আমার আমি বলে আসলে কিছুই হয় না!
|
শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী |
|
|
|
|
|