অনন্তের স্পর্শ
দুর্গা বলতেই আমার সামনে একটা আশ্চর্য পীতবর্ণ!
কিংবা হরিদ্রাবর্ণ! হলুদ!
কেন হলুদ, তা নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে, খুব সংক্ষেপে তার কিছু কিছু বলার চেষ্টা করব, কিন্তু তার আগে বলি, শিল্পী সনাতন দিন্দার চোখ ‘দুর্গা’র রূপকল্পে হলুদ বর্ণটিই আবিষ্কার করে সবার আগে।
তার কারণ কি এই যে বিভিন্ন মতে সূর্যদেবের কল্পনা থেকেই দেবীরূপের বিকাশ? ‘তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভ্যাম্’ বলে দেবীর বর্ণনা তো পাওয়াই যাচ্ছে। অবশ্য, এই যে দেবীর দৃশ্য-রূপ, তা সম্পূর্ণ বৈদিক কি না, তা নিয়ে তর্ক আছে ঢের। সেই বিতর্কের মধ্যে এখানে যাব না, কারণ এখানে আমার বিষয় রং! দেবীর বর্ণকল্পনা।
ঋগ্বেদ মতে আদিবর্ণ তিনটি, ‘লোহিতকৃষ্ণশুক্লাম্’। ছান্দোগ্য উপনিষদে আসুন। সেখানেও বলা হচ্ছে, তিনটি বর্ণই আদি, ‘ত্রীণি রূপাণীত্যেব সত্যম্’। অগ্নি বা সূর্য হল লোহিত। জল বা বরুণ হল শ্বেত। পৃথ্বী বা পৃথিবী হল কৃষ্ণ।
আবার দুর্গার বর্ণ-মালা যদি ধরেন, তা-ও ত্রিবর্ণরঞ্জিত! তিনি প্রাতে সরস্বতী, অর্থাৎ শুক্লাবর্ণা। মধ্যাহ্নে তিনি হরিদ্রাবর্ণা। সায়াহ্নে তিনি লোহিত-স্বর্ণবর্ণা! স্পষ্টই বোঝা যায়, দিনের তিনটি বিভিন্ন সময়ে সূর্যের তিন রকম রঙেরই আভাস আছে এই বর্ণনায়। সেই রং থেকেই ভেবে নেওয়া হয়েছে দেবীর তিন রকম বর্ণ!
আমার কাছে, ওই যা বলছিলাম, দেবী হরিদ্রাবর্ণা। আবার, অসুর বললেই, কেন জানি না, মনে পড়ে সবুজ! কেন মনে পড়ে, তা ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না ঠিকঠাক, আসলে ছোট থেকেই অসুরের গায়ের রং এমনই সবুজ দেখেছি যে, চোখ বুজে যদি অসুরকে ভাবতে বলা হয়, তা হলে সবার আগে সবুজ রংটাই আসবে।
এই পর্যন্ত এসেই মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। স্মৃতি। তার কি কোনও আকার হয়? বর্ণ হয়? অন্তত আমার কাছে, বা আমার ধারণা, কোনও শিল্পীর কাছেই, স্মৃতি খুব নিরাকার বায়ুভূত কোনও জিনিস নয়। স্থান-কাল-সাপেক্ষে তার নানা রকম আকার, নানা রকম রং... ঠিক যেমন দুর্গাপুজো। স্মৃতির মধ্যে আলো ফেললে দেখা যাবে কী বিচিত্র তার শোভা!
সেই শোভার মধ্যে অনন্তের স্পর্শ আছে।
আসলে, আমাদের এই দুর্গাপূজার আয়োজনের মধ্যেও কি সেই অনন্তের ছোঁয়াচটি নেই? প্রতি বছর একটি উৎসব হয়ে চলেছে। নিয়ম করে। বছরের বাকি দিনগুলো কার্যত নিয়ম করেই যারা বর্ণহীন, তারাই আচমকা কী আশ্চর্য জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বর্ণিল হয়ে উঠছে মাত্র কয়েকটা দিন। যে গলিটা রোজই পড়ে থাকে ধূসর পাণ্ডুলিপির মতো, সে-ই হঠাৎ রঙে রঙে উন্মাদ! এই রং মানুষকে আকর্ষণ করে। নিজে যখন ছবি আঁকি, অজস্র রং যে ব্যবহার করি, এমন নয়। সীমিত রং, তা-ও থাকে মনোক্রোমের মতো, কোনও একটি বিশেষ রঙের তারতম্য দিয়েই গোটা ছবিটি গড়া, কিন্তু তার মধ্যে, বিশেষ কিছু জায়গায় থাকে কোনও উজ্জ্বল রং। সেটাই চক্ষুকে টানে। এই যদি আমার ক্যানভাসের একটা মূলগত চালচিত্র হয়, তা হলে দুর্গাপুজোর সময় আমি নানা রকম রঙের খেলায় মাতি!
যদি এ রকম ভেবে নেওয়া যায় যে আমাদের কাছে বছরের বাকি দিনগুলো ওই মনোক্রোম, খালি একটা রঙ নিয়েই তার কম-বেশির খেলা, তা হলে এই কয়েকটা দিন আমার কাছে ওই অ্যাকসেন্ট কালার! রঙের উৎসব! দেখতে দেখতে লোকে ভুলে যাবে, পিছনটা ধূসর ছিল, এই উৎসবের আলোটা নিভে গেলে আগামীটাও হয়তো একই রকম ধূসর ঠেকবে, মাঝখানে ইন্দ্রজালের মতো এই কয়েকটা রঙিন দিন জেগে রইল মানসপটে।
সেই সব রং যেন উৎসবমত্ত জনতারই মনের প্রতিচ্ছবি, তাদের সানন্দ শরীর থেকে উঠে আসছে, আবার মিলিয়েও যাচ্ছে তাদেরই শরীরে, মনে... ফের জেগে উঠছে, পাশে রাত্রির পটে কত রকম রঙিন আলপনা আঁকছে এল ই ডি বালব, ভিড় চলেছে কখনও সুশৃঙ্খল, কখনও আবার সামান্য বিশৃঙ্খল রূপে, সেই ভিড়ের গায়ে, জনারণ্যের গায়ে ঘুরছে, লেপটে যাচ্ছে রং। বাচ্চারা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে সে দিকে। বড়রাও অ-বাক, হয়তো কোনও টুকরো মুহূর্তে মনে করছেন ছোটবেলার স্মৃতি, সে-ও তো কত রকম রঙে গড়া, ফলে শরীরের বাইরের রং এবং মনের ভিতরে নানা রকম রং নিয়ে গড়ে উঠছে ক্যালাইডোস্কোপ! এই যে দরিদ্র বধূটিও নিত্যদিনের ময়লা কাপড়টি সরিয়ে গায়ে চড়াল সযত্নে তুলে রাখা একটি রঙিন শাড়ি, সেই বৃদ্ধা, যাঁর কাছে জীবনের সমস্ত রং-ই নিভে গিয়েছে প্রায়, তিনিও দূর যৌবনের কোনও রঙিন স্মৃতির কথা ভেবে আনমনা হলেন, সেই সব রংও কি দুর্গার উৎসবে ঠাঁই পেল না?
পেল। সব মিলিয়ে তৈরি হল স্মৃতি আর সত্তা দিয়ে গড়া একটি ক্যানভাস। এই ক্যানভাসটি ত্রিমাত্রিক! ঠিক আমাদের চারপাশটি যে রকম। তার সঙ্গে এখানে আছে আর একটি মাত্রা।
চতুর্থ মাত্রা।
সময়। ঠিক, আমাদের জীবনেও যে রকম আছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটাই কি সেই শিল্পরূপ নয়, যাকে আধুনিক শিল্প-পরিভাষায় বলা হচ্ছে, ইনস্টলেশন! মনে পড়ে, প্রয়াত মকবুল ফিদা হুসেন একদা দুর্গাপুজোর এই আয়োজনকে ইনস্টলেশন-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যথার্থই তা-ই। টানা বেশ কিছু দিন ধরে এত লোকের অক্লান্ত খাটনি মাত্র কয়েকটি দিন লোকের সামনে দৃশ্যমান, তার পরেই বিসর্জন। রাত্রির কালো গঙ্গা গিলে নেবে এই রং, এই সব আকার, একে একে খুলে নেওয়া হবে সমস্ত বাঁশ, কাঠ, কাপড়, আলো...
আমি যে পুজোগুলি করি, তারও বিসর্জনের বাজনা বাজে এক সময়। যেমন রীতি। মিথ্যে বলব না, কষ্ট হয়। বুকের মধ্যে কোথাও একটা চিনচিন করে। আবার, তখনই বুঝতে পারি, আসলে এটাই হল দুর্গাপুজোর প্রকৃত রং। ক্ষণিকের সঙ্গে অনন্তের একটি আশ্চর্য সংলাপ। সেই সংলাপের রং কী, ঠিক জানি না।
তার তুলনা কি আকাশ? আকাশের অনন্ত বিস্তার! ফলে, নীল!
আশ্চর্য, তন্ত্রেও নীলতারা নামে একটি রূপকল্প আছে। সেই নীল রংটিও কি এই অনন্তের স্পর্শ নয়? আবার, ধরা যাক, মার্কণ্ডেয়পুরাণে যে দেবীকে ‘শাকম্ভরী’ বলে উল্লেখ করা হল, রামায়ণ এবং অর্থশাস্ত্রেও বলা হল তিনি শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, সেই সবুজও কি আসলে অনন্তেরই রং নয়?
আমরা জানি, ক্ষণিকের এই দ্যুতি, এই
রং ফুরোবে। আবার ফুরোবেও না।

শিল্পী: উপল সেনগুপ্ত



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.