|
|
|
|
সর্বংসহা |
ধরিত্রীও, ধর্মের মতোই, ধরে রাখে। ধরে রাখাই যার কাজ, তাকে সর্বসহিষ্ণু হতেই হবে। সে যদি বলে,
‘আমি সহ্য করব না’, তা হলে তো দুনিয়া রসাতলে যাবে, জানকীর মতোই।অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
সেই এক বার তিনি বিদীর্ণ হয়েছিলেন। সর্বংসহাকে তাঁর সহনশক্তির সীমান্ত পার করিয়ে দিয়েছিলেন রঘুকুলপতি। কন্যার অপমান অসহ হয়েছিল তাঁর। স্বাভাবিক। জানকী তো যে সে কন্যা নন। কথায় কথায় মায়ের কাছে নালিশ জানাবেন, তেমন স্বভাব তো তাঁর নয়। সেই চিরসহিষ্ণু কন্যাও যখন আর পারলেন না, অযোধ্যার রাজদরবারে কৃতাঞ্জলি হয়ে অধোবদনে নিম্ন দিকে চেয়ে বললেন, ‘যদি আমি রাঘব ভিন্ন অন্য কাকেও মনে মনেও চিন্তা না করে থাকি তবে মাধবী দেবী বিদীর্ণ হয়ে আমাকে আশ্রয় দিন’, তখন জননী ধরিত্রীর সহন শেষ হল। তখন ‘ভূতল থেকে এক আশ্চর্য অত্যুত্তম দিব্য সিংহাসন উত্থিত হল।’ এবং ‘ধরণী দেবী স্বাগত সম্ভাষণে মৈথিলীকে অভিনন্দিত করলেন এবং তাঁকে দুই বাহু দ্বারা ধারণ করে সেই সিংহাসনে বসালেন।’ অতঃপর জনকদুহিতার পাতালপ্রবেশ। আসলে সীতার মাতৃগৃহে গমন।
রাজশেখর বসুর জবানিতে এই কাহিনি যখন পড়ি আমরা, বিষণ্ণ হয়ে উঠি। তিক্তও। একটা মেয়ে সারা জীবন কেবল দুঃখ পেয়ে গেল আর প্রিয়তম মানুষটির কাছে অসীম অবিচার সহ্য করে গেল, সেই দুঃখ আমাদের বিষণ্ণ করে, সেই অবিচার আমাদের তিক্ত করে। কিন্তু আর এক জনের কথা আমরা বেমালুম ভুলে থাকি, তাঁকে দেখেও আমাদের তাঁর কথা মনে পড়ে না। তিনি মাধবী দেবী জননী বসুন্ধরা। সেই কবে হলকর্ষণের সময়ে তাঁর আশ্রয় থেকে শিশুকন্যাকে তুলে নিয়েছিলেন মিথিলাধিপতি। তার পর নীরবে কন্যার জীবনপটটি অবলোকন করে গিয়েছেন ধরিত্রী। একটু সুখ, বাকিটা দুঃখ। একটু সম্মান, বাকিটা অপমান। জননী নীরব, নিস্পন্দ। নিস্পন্দ? তা-ও কি হয়? কন্যার জীবনতরঙ্গ তাঁকে স্পন্দিত করেনি? সম্ভব? আমরা সেই স্পন্দন বুঝিনি, অনুভব করিনি তার রেশ, সে আমাদের অক্ষমতা। আর তাই যখন শেষ দৃশ্যে মেদিনী বিদীর্ণ হয়, তখনও আমরা লক্ষ করি না, সিংহাসনে আসীনা জননীর মুখে কত যন্ত্রণা আঁকা রয়েছে! কেনই বা করব? আমরা তো জানি, তিনি সব সহ্য করেন। চিরকাল তাই করেছেন, চিরকাল তাই করবেন। সব সহ্য করে যে, সে হল সর্বংসহা বহুব্রীহি সমাস। |
|
ছোটবেলায় যখন মাটির মানুষ কথাটা শুনতাম, ঠিক বুঝতে পারতাম না। যে মানুষ মাটির পুতুলের মতো? নড়াচড়া করে না, ছোটে না সে হাঁটে না, কাউকে সে কাটে না? কিন্তু সে তো কাঠের পুতুলও তাই। তা হলে কাঠের পুতুল না বলে মাটির মানুষ বলা কেন? আর, মৃণ্ময় প্রতিমা দেখে নিশ্চয়ই ও কথা কেউ ভাবেননি, দুর্গা থেকে কালী যে প্রতিমাগুলির সঙ্গে আমরা সমধিক পরিচিত, তারা কেউ, আর যাই হোক, মাটির মানুষ নয়। তা হলে? আসলে কথাটা মানুষের ধর্ম মেনে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে মাটির ধর্ম মেনে। মাটির মানুষ মানে জড়ভরত নয়, কাদার তাল নয়, মাটির মানুষ মানে যে মানুষ মাটির মতো, ধরিত্রীর মতো, যে সব সহ্য করে। সহ্য করতে হবে বলে সহ্য করে না, সহ্য করাটাই তার স্বভাব। জানকী সারা জীবন পুড়ছেন, কাঁদছেন, অপমানে অন্যায়ে অবিচারে বিক্ষত হচ্ছেন, বসুন্ধরা সহ্য করছেন, নিরন্তর, অবিচল। সহনই তাঁর ধর্ম। মৃত্তিকার ধর্ম।
স্বভাবধর্ম। ধর্ম এবং ধরিত্রী, একই উৎস থেকে সঞ্জাত দুটি শব্দ। ধরিত্রীও, ধর্মের মতোই, ধারণ করে, ধরে রাখে। ধরে রাখাই যার কাজ, তাকে সর্বসহিষ্ণু হতেই হবে। সে যদি বলে, ‘আমি সহ্য করব না’, তা হলে তো দুনিয়া রসাতলে যাবে, জানকীর মতোই। আমরা তার এই স্বভাব জেনে গিয়েছি, অতএব তার ওপর অনন্ত দাপট আমাদের। আজ নয়, সে দাপট শুরু হয়েছে অন্তত দশ সহস্রাব্দ আগে, যে দিন প্রথম মানুষ কৃষিকাজ জানল। আমরা যখন মা-মাটি-মানুষ বলে আবেগে আপ্লুত হই, তখন মনে রাখি না, কর্ষণই মাটির ওপর মানুষের প্রথম অত্যাচার। মাটি কোনও দিন কিছু বলেনি। আমরা লাঙল ছেড়ে মেশিন চালিয়েছি তার বুকে, পবিত্র গোময় ছেড়ে ঢেলেছি তীব্র রাসায়নিক, সে একমনে সোনা ফলিয়েছে, যখন আর পারেনি, তখনও প্রতিবাদ করেনি, নীরবে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে।
তার পর কৃষি থেকে শিল্প, গ্রাম থেকে শহর, উন্নয়নের সরণি বেয়ে প্রগতির পথে হেঁটেছি আমরা, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত, বিপর্যস্ত হয়েছে ভূমি। ইমারতের সারি মাথা তুলেছে আকাশে, তার ভিত প্রোথিত হয়েছে মাটির গভীরে, আরও গভীরে, ইট কাঠ কংক্রিট লোহার খাঁচায় ভরে উঠেছে ধরিত্রীর গর্ভ, সে বিনা প্রতিবাদে বহন করেছে এই অনন্ত নাগরিক জঞ্জাল। উন্নয়ন আর প্রগতি আর সভ্যতার অসীম তৃষ্ণা মেটাতে মাটির বুকের মাঝে সযত্নসঞ্চিত জলধারা তুলে এনেছি অকাতরে। সেই মহালুণ্ঠনের দৃশ্য অবলোকন করলে অর্জুন স্তম্ভিত হতেন, তাঁর গাণ্ডীব লজ্জিত হত। শরশয্যাশায়ী পিতামহ ভীষ্মের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ভূমি বিদীর্ণ করে জল এনেছিল তাঁর শরজাল, এই আদিগন্ত সমৃদ্ধির পিপাসা মেটানোর দায় তিনিও গ্রহণ করতেন না, অক্ষমতার কারণে নয়, নৈতিক দায়িত্বের অনুশাসনে। আমরা নির্দায়। এবং নির্দয়।
সত্য বটে, কেবল মাটি নয়, আমরা সমগ্র প্রকৃতির প্রতি নির্দয়, নির্মম। জলের প্রতি, বায়ুর প্রতি, অরণ্যের প্রতি। কিন্তু জল, বায়ু, অরণ্য, প্রত্যেকটিকে নিয়ে আমরা আবার চিন্তিতও। সেই চিন্তার তাড়নায় অধুনা ঈষৎ সংযত হওয়ার চেষ্টাও করছি। কিন্তু মাটি? সে তো পায়ের নীচে থাকে, তার সর্বনাশ করার আগে কখনও ভাবতে হয় না, নিজেদের সংযত করার কোনও প্রয়োজন হয় না। তাকে নিয়ে যা-ই করি, সে পায়ের নীচেই পড়ে থাকবে, স্থান দেবে, মেনে নেবে, রা কাড়বে না।
কোথা থেকে পেল মাটি, তার এই স্বভাব? এই অপার সহিষ্ণুতা? আমরা ভাবি না। ভাবি না কোথা থেকে এল সে? ‘মাটিতে জন্ম নিলাম’ বলে গান গাই, মাটির জন্ম কে দিল, সে ভাবনা আমাদের মনে আসে না কখনও। নদীকে ডেকে শুধাই, বলো, কোথায় তোমার দেশ, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? মাটির কাছে কখনও সে প্রশ্নের জবাব জানতে চাই না। সে আসেও না, যায়ও না, সে বলে ‘আছি’, ব্যস্। তাই তার স্বভাবের রহস্য আমাদের অগোচর থেকে যায়।
স্বাভাবিক। কারণ, জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে। মানুষেরও, মাটিরও। মাটির জীবনধারাটি খেয়াল করলেই সে কথা দিব্যি বোঝা যাবে। আক্ষরিক অর্থেই জীবনধারা। মাটি পাথরের সন্তান। জলেরও। জলধারায় পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভেঙে ভেঙে মাটির জন্ম। এক দিনে নয়, দু’দিনে নয়, সেই জন্মবৃত্তান্ত চলতে থাকে কল্পকল্পান্তর ধরে। সে এক অতিদীর্ঘ নিরন্তর সংঘাতের কাহিনি। সেই সংঘাতে যোগ দেয় অন্যরাও, যোগ দেয় রোদ্দুর, যোগ দেয় বাতাস, যোগ দেয় মহীরুহ থেকে তৃণরাজি, যোগ দেয় কীটানুকীট। সবাই যে যার নিজের মতো করে পাথরের ভাঙন আর ক্ষয়কে এগিয়ে নিয়ে যায়। এক দিন পাথর দেখে, সে আর পাথর নেই, মাটি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই মৃত্তিকার অন্তরে প্রস্তর থেকে যায়, তার স্ব-ভাব নিয়ে। আমরা লক্ষ করি না, মনে রাখি না, তার কারণ এই রূপান্তরের সবটাই ঘটে আমাদের চোখের আড়ালে, কিন্তু এ এক অলৌকিক পুনর্জন্মের কাহিনি। যে পাহাড় তার বজ্রকঠিনতার জন্য বন্দিত, যার অতুলনীয় স্থিতি তাকে ‘অচল’ নাম দিয়েছে, সেই পাহাড় ভেঙে যায়, গুঁড়িয়ে যায়, কিন্তু তার অবিচল স্থিরতা হারায় না, বেঁচে থাকে মাটির মধ্যে।
এবং বেঁচে থাকে তার ঔদ্ধত্য, তার অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে। পাহাড় উদ্ধত, অহঙ্কারী, মাটি স্বভাবত বিনয়ী, তার স্থান অনিবার্য ভাবে তৃণ অপেক্ষাও সুনীচ। প্রস্তরের কাঠিন্য মৃত্তিকায় এসে এক স্নিগ্ধ স্থিরতা অর্জন করে, যে স্নিগ্ধতা জলধারার দান। স্নিগ্ধ বলেই সেই স্থিরতা আরও মহিমময়। সে পাথরের মতো প্রত্যাখ্যান করে না, ধরে রাখে, সহ্য করে, মিশিয়ে নেয়। মিশিয়ে নেয় সব কিছুকে শরৎপ্রাতে ঝরে পড়া শিউলি ফুল, অনাদরে ছুড়ে দেওয়া কলার খোসা, কাঁঠালের ভূতি, মাছের কান্কা, মরা বেড়ালের ছানা, মাঝরাতে চুপিসাড়ে খুন হয়ে যাওয়া গাঁয়ের বধূ, কুরুক্ষেত্রে শেষ হয়ে যাওয়া আঠারো অক্ষৌহিণী কাউকে ফেরায় না সে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, সব্বাই মাটি হয়ে যায়। মাটি হয়ে যায় ব্যবিলন এবং মহেঞ্জোদরো, রোম ও কার্থেজ, তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড়, চিনের প্রাচীর, রুশ ক্রেমলিন, মার্কিন ম্যানহাটান... আজ না হয়, কাল, কিংবা পরশু। এক দিন মাটি সবাইকে গ্রাস করে নেয়। নেবে। নেবেই। সর্বংসহা সে, সর্বগ্রাসিনীও। নীরবে পায়ের নীচে পড়ে থাকে সে। জানিও না, কোন দিন কী ভাবে সে পায়ের নীচ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে, আমরা আমাদের উত্তুঙ্গ দম্ভ আর অমিত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, আমাদের নির্দয় নির্মম উন্নয়ন আর প্রগতির অসমাপ্ত ইতিহাস নিয়ে মহেঞ্জোদরো হয়ে যাব। মৃত্তিকা ভারী সুন্দর। এবং ভীষণ। অমিতশক্তিময়ী।
অবিকল মৃণ্ময়ী শারদপ্রতিমার মতোই।
|
শিল্পী: উপল সেনগুপ্ত |
|
|
|
|
|