সরকারি চিকিৎসকদের ‘লাগামছাড়া’ প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে এ বার রাশ টানতে চাইছে রাজ্য সরকার। জেলায় জেলায় তো বটেই, খাস কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও শুরু হয়েছে আচমকা পরিদর্শন। কাজের সময়ে কোনও সরকারি চিকিৎসককে হাসপাতালে না পেলে তাঁদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। ইতিমধ্যেই ‘ফাঁকি দেওয়া’ চিকিৎসকদের কয়েক জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর।
বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯০ সালে সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিস নিষিদ্ধ করেছিল। এর ১৫ বছর পরে, ২০০৫ সালে বাম সরকারের আমলেই ফের প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে তার কিছু শর্তও ছিল। যেমন, হাসপাতালে ডিউটির নির্ধারিত সময়ের পরেই প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে যাওয়া যাবে। কে কোথায় প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করছেন, তার সমস্ত তথ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে থাকবে। হাসপাতালের ২০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করা যাবে না, রোগীর প্রয়োজনে প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে না গিয়ে হাসপাতালে থাকতে হবে, ইত্যাদি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সব শর্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের রমরমা চলছে। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে রোগী অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় সময় গুণছেন, আর চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালের ওটি-তে ব্যস্ত, এমন ঘটনা আকছার ঘটছে। বাম সরকারের আমলে কোনও নজরদারির ব্যবস্থা না থাকাতেই বিষয়টি আরও বেড়েছে বলে মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সেই কারণেই প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে লাগাম পরাতে এ বার উদ্যোগী স্বাস্থ্য দফতর।
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কতৃর্পক্ষের দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ কোন চিকিৎসক কতটা সময় হাসপাতালে থাকছেন বা থাকছেন না, সেটা জানা তাঁদের পক্ষে তুলনামূলক ভাবে সহজ। কিন্তু তাঁরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী বলে সব জেনেও চুপ করে থাকেন। এ বার তাঁদের দায়বদ্ধতাও বাড়ানো হবে। শুধু সেই চিকিৎসক নয়, কৈফিয়ত তলব করা হবে সুপার এবং বিভাগীয় প্রধানদেরও।”
দিন কয়েক আগে মালদহের একটি হাসপাতালে গিয়ে তাজ্জব হয়ে যান স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। সেখানে একটি হাসপাতালে ছ’জন স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক, অথচ গত এক বছরে সিজার হয়েছে মাত্র পাঁচটি। কেন এমন অবস্থা? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জেনেছেন, ওই চিকিৎসকেরা হাসপাতালে থাকেনই না, আর থাকলেও সিজার করার জন্য তাঁদের নার্সিংহোমই বেশি পছন্দ। হাসপাতালের আউটডোর থেকে তাই নিজেরাই অবলীলায় রোগী রেফার করেন নার্সিংহোমে। গাজোলের এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু’জন স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক এবং দু’জন অ্যানাস্থেটিস্ট রয়েছেন, তা-ও সেখানে সিজার করা যাচ্ছে না। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, কারণটা এ ক্ষেত্রেও একই। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “জেলা হাসপাতালগুলি থেকে হামেশাই বলা হয়, চিকিৎসকের সংখ্যা না বাড়ালে পরিষেবার মান উন্নত করা সম্ভব নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই পরিকাঠামোতেই যে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব, তার অর্ধেকও দেওয়া হচ্ছে না।”
হাসপাতালে গরহাজির থেকে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে মন দেওয়ার নজির মিলেছে অন্য জেলাতেও। মেদিনীপুরের এক হাসপাতালে দেখা গিয়েছে, চিকিৎসকেরা নিজেদের মধ্যে ডিউটি ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। সপ্তাহে ছ’দিনের পরিবর্তে এক-এক জন এক-এক দিন করে ডিউটি করছেন। বাকি পাঁচ দিন ছুটি! বর্ধমানের এক হাসপাতালে অর্থোপেডিক শল্য চিকিৎসক সপ্তাহে দু’দিনের বেশি থাকেন না। কলকাতায় এসএসকেএমের মতো সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে দেখা গিয়েছে, দুপুর দেড়টা-দুটোর পরে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই অদৃশ্য। স্বাস্থ্যকর্তারা জেনেছেন, দক্ষিণ কলকাতার কয়েকটি নার্সিংহোম ও বেসরকারি হাসপাতালে তাঁরা ঘোষিত ভাবেই দুপুর দুটো থেকে রোগী দেখছেন। নীলরতন সরকার হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক প্রতি শনিবার হাজির খাতায় সই করে বর্ধমানে রোগী দেখতে চলে যান বলে অভিযোগ। হাসপাতালের প্রাক্তন ও বর্তমান অধ্যক্ষ একাধিক বার হুঁশিয়ার দিয়েও লাভ হয়নি। এমনকী ওই চিকিৎসকের হাজিরা খাতায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গরহাজিরা সম্পর্কে মন্তব্য লিখেও তাঁকে বাগ মানাতে পারেননি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অভিযোগ মেনে নিয়েই বলেছেন, “আগে মাঝে মাঝে চলে যেতাম। এখন আর যাব না!” |