জমিদারি আজ আর নেই। বিশাল দোতলা বাড়িটা হারিয়েছে অতীত জৌলুসও। কিন্তু ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যে আজও উজ্জ্বল উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার মুখোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজো। যা জমিদারবাড়ির পুজো হিসাবেই বেশি পরিচিত। গোবরডাঙায় বেড়েছে থিমপুজোর সংখ্যা। রাত জেগে বড় বড় মণ্ডপ ঘুরে প্রতিমা দেখেন এলাকার মানুষ। কিন্তু গোটা গোবরডাঙা এবং সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের কাছে আজও সমান ভাবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জমিদারবাড়ির পুজোই। অন্তত এক দিন তাঁরা তুলে রাখেন জমিদারবাড়ির পুজো দেখার জন্য।
মুখোপাধ্যায় পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, গোবরডাঙায় এই পুজোর বয়স ৩০০ বছরেরও বেশি। ওই পরিবারের পূর্বপুরুষেরা প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর আগে লখনউ থেকে বাংলাদেশের সারসার সাগরদাঁড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন। ওখানেই পুজোর সূচনা। পরবর্তী সময়ে পরিবারের শ্যামরাম মুখোপাধ্যায় গোবরডাঙার ইছাপুরে আসেন। এখানকার জমিদার চৌধুরী পরিবারের মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সেই সূত্রে তিনি এখানে জমিদারির একাংশের ভাগ পান। তাঁর ছেলে খেলারাম মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশ কালেক্টরের হয়ে কাজ করতেন। |
দেড় বিঘা জমির উপরে বাড়িটি অবশ্য ব্রিটিশদের তৈরি। খেলারাম বাড়িটি কিনে নিয়ে এখানে পুজোর পত্তন করেন। তিনি ও তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা দোতলা বানান। এই বাড়িতে বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্র, রানি রাসমণির মতো বিশিষ্ট জনদের পদধূলি পড়েছে বলে জানান ওই পরিবারের বর্তমান সদস্য স্বপনপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।
পুজোর ইতিহাস নিয়ে বলতে গিয়ে স্বপনবাবু জানান, আগে মোষবলি-পাঁঠাবলি হত পুজোর সময়ে। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। তার পরিবর্তে পাঁচ পোয়া চিনি ও এক পোয়া মধু দেওয়া হয় মা দুর্গাকে। জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজো হয়। এখানে দেবী দশভূজা ‘প্রসন্নময়ী দুর্গা’ নামে পরিচিত। খেলারাম জমিদারবাড়ির পাশেই প্রসন্নময়ী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিপদে ওই কালীমন্দিরে ঘট স্থাপন করা হয়। সপ্তমীর দিন ঘট আনা হয় জমিদারবাড়িতে।
প্রতিমা একচালার। অতীতে ষষ্ঠীর দিন কামান দাগা হত। গোবরডাঙার মানুষ বুঝতে পারতেন, পুজো শুরু হল জমিদারবাড়িতে। দশমীর দিন সন্ধ্যার আকাশে একটি তারা দেখা গেলেই যমুনায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার রীতি এখনও মেনে চলা হয়। পরিবারের সদস্যেরা জানান, অতীতে জমিদারবাড়ি থেকে যমুনার ঘাট পর্যন্ত বহু মানুষ বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সামিল হতেন। থাকত হাতি। নৌকার করে দেবীকে ঘুরিয়ে বিসর্জন দেওয়া হত। এখন আর হাতি থাকে না। বিসর্জনের শোভাযাত্রাতেও আর তেমন ভিড় হয় না। যমুনা মজে যাওয়ায় বিসর্জনের সময়েও দেবীকে নৌকায় ঘোরানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে কবেই। পুজোর দিনগুলিতে যাত্রাপালাও হারিয়ে গিয়েছে। তবু এখনও পুজোর দিনগুলিতে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজন ও শরিকরা গোবরডাঙায় আসেন। এক সঙ্গে পুজোয় মাতেন। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় পুরনো আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি মেনে চলা হয় আজও। |