খাইবার পাস

ক্যাম্পারির রোল-বিরিয়ানি ****
একডালিয়ার ঠাকুর দেখে ফের গড়িয়াহাট হয়ে উল্টো দিকে সিংহীপার্ক কভার করে শরীরে ক্যালরি ঘাটতি ভালই হবে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিরিয়ানির মত বন্ধু আর কে আছে! সিংহীপার্ক থেকে বেরোনোর পথে রমণী চ্যাটার্জি স্ট্রিট ও রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাঁকে একটু দাঁড়ান। ক্যাম্পারির ফিশ ফ্রাই আর রোলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহু দিনের। কিন্তু স্পেশাল বিরিয়ানি স্রেফ পুজোয়। চিকেন ও মাটন সংস্করণ দু‘টোই হাজির। জনৈক লখনউয়ি বাবুর্চির মন্ত্রগুপ্তি চুরি করে রপ্ত শিল্প। মাংসের নির্যাসে মাখো-মাখো তবু ঝরঝরে। রোলেও এ কলকাতার অবক্ষয় ক্যাম্পারিকে ছুঁতে পারেনি। পেঁপের রসে জারিত মাটন কাবাবে চুমু খাওয়া যায়। কাঠকয়লার আঁচে শুদ্ধ কাবাব ও পরোটার প্রেমে উটকো ক্যাপসিকাম-অর্বাচীন সসের প্রবেশ নিষেধ। লেবু-লঙ্কা আলাদা দেওয়ার দস্তুর। তবে হ্যাঁ, রাত ১১টা বেজে গেলে বিরিয়ানির শূন্য হাঁড়িতে পিঁপড়ের কান্না শুনতে হবে।
ফিয়ার্স লেনের সুতি কাবাব ***
এর জন্য নতুন জুতোর ফোস্কা তুচ্ছ। মহম্মদ আলি পার্ক দেখে বেরিয়ে অনেকটা হণ্টন। পদাতিকদের ব্যারিকেড বা ঘিঞ্জি রাস্তা ধরে এগোতে অর্জুন তবু পাখির চোখ দেখছেন। কলুটোলা স্ট্রিটের ভিড় ঠেলে ফিয়ার্স লেনে ঢুকে হাজি আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকান পেরিয়ে সেই ঠিকানা। গাড়িতে চিৎপুর রোড বা বিবি গাঙ্গুলি দিয়ে ঢোকাই শ্রেয়। গলির ধারে শিকে গাঁথা মাংস ফি-সন্ধেয় সুতো জড়িয়ে তপ্ত কয়লায় সেঁকা হচ্ছে। গিঁট খুলে ঝড়ের গতিতে শালপাতায় পরিবেশন। দিল্লি-লখনউয়ের কাকোরি-গালোটিকে কলকাতার জবাব এই গলিজাত সুতি কাবাব। কাকোরি-গালোটির মতোই তুলতুলে নরম। হরধনু তোলা সম্ভব। কিন্তু সুতোর বাঁধন ছাড়া মিহিতম মাংস দু’আঙুলে ধরতে
গেলে ঝুরঝুরিয়ে পড়ে। খেতে দাঁতের খাটুনি নেই। উৎসবের দিনে নিষিদ্ধ অভিজ্ঞতা-সঞ্চয় প্রাচীন ট্র্যাডিশন। অনেকের ‘নিষিদ্ধ’ মাংসে দীক্ষাও এই লগ্নে। তবে সঙ্গে চিকেন বোটি কাবাবও মজুত। সুতি কাবাব মুখে দিলে মনে হবেই, বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই।
বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা ****
বালিগঞ্জ কালচারাল ও সমাজসেবী পর পর দেখে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের দিকে বেরোতেই লেকের ঠান্ডা হাওয়া যেন ঐশ্বরিক করুণা! এর পরে পা দু’টো নিজের অজান্তেই ডাইনে বিবেকানন্দ পার্কের দিকে এগোবে। ‘মহারাজা চাট সেন্টার’-এর সেলিব্রিটি ফুচকা-শিল্পী দিলীপ সাউয়ের দেখা না-মিললে পুজোটা আফশোসে কাটবে। পাতিনেবু-তেঁতুলজল-জিরে মশলার সাবেক কম্বোয় এখন গন্ধলেবু-পুদিনার বিবর্তন। মিনারেল ওয়াটারে টকজলের উত্তরণ। কিন্তু ফুচকার স্বাদ আদি-অকৃত্রিম। টকজলের জালায় ফুচকার ডুবের আগের মুহূর্তে মশলা গুলতে দেখলে অবধারিত জিভটা শিরশিরিয়ে ওঠে। নানা কিসিমের ভ্যারাইটি। ক্লাসিক ফুচকা ছাড়াও দই ফুচকা, বিউলির ডাল-বেসনের বড়ার পুর-ভরা মিঠা ফুচকা, বা খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনির স্পর্শে ঝাল-মিষ্টি চুরমুর। দিলীপ এখন শহরের বড়ঘরের থিম-পার্টিতে এন্তার বরাত পান। কলকাতার এই ফুচকা-হাবের বাকি শিল্পীরাও কম যান না।
মিত্র কাফের ছানার পুডিং *****
কনে দেখতে এসে যেমন, কনের বোন বা বউদিকে দেখে ক্লিন বোল্ড! কবিরাজি-আফগানির ঘ্রাণের মাদকতার আড়ালে এই নেপথ্যচারিণীর সঙ্গে অনেকেরই দেখা হয়নি। কিন্তু দেখা হলে নির্ঘাত মরেছেন। কুমোরটুলি পার্ক কি বেনিয়াটোলা-আহিরীটোলার ঠাকুর দেখে বেরিয়ে গ্রে স্ট্রিটের মোড়ে অপারেশন মিত্র কাফে। চপ-কাটলেট সাঁটিয়ে ফ্রিজে আধশোয়া এই অন্তঃপুরবাসিনীর সঙ্গে আলাপ করুন। পাঁচতারার হেঁসেলকেও গাড়ল মনে হবে। বাঙালির রসগোল্লা, সাহেবি ডেজার্ট ও আইসক্রিমের সব ভালটুকু মিশেছে নিখাদ ছানার এই পুডিংয়ে। নতুনবাজারের ছানার আঁটোসাঁটো দেহবল্লরীতে ভর করে বিলিতি পুডিং জাতে উঠেছে। আগে হাঁসের ডিমের কুসুমে হলুদবরণ গায়ে একটি চেরি চুণীর মতো জ্বলত। এখন চকোলেট ফ্লেভারের ছোঁয়ায় কু-ল ‘ডাস্কি’ আবছায়া। মিত্র কাফের দক্ষিণের শাখা গোলপার্কেও আগাম ফরমায়েশে মেলে। ক্লাসিক ক্যালকাটা কুইজিনের ক্রমশ বিরল একটি সার্থক রচনা। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি সন্দেহ কী! জলের দরের এই মাধুর্য জিভে অধিষ্ঠান করলে বুঝবেন পুজোর সব থেকে ঘ্যাম সুন্দরী ইনি-ই!
লক্ষ্মীনারায়ণের তেলেভাজা ***
“চপ খাব আস্ত
তৈরি করব স্বাস্থ্য
বেগুনি খাব গোটা
আমরা হব মোটা
পেঁয়াজি খাব শেষে
খাব ভালবেসে।”

এমন স্বাস্থ্যচিন্তা কিংবদন্তী অভিনেতা জহর রায়ের। তখন রংমহলের শো শেষে মেক-আপ তোলার আগেই উল্টো দিকের ফুটপাথে গরম তেলেভাজার টানে ভিড় করতেন আর্টিস্টরা। সে-স্বাদের প্রেরণায় স্বহস্তে এই মন্ত্র লিখে দেন জহর রায়। লক্ষ্মীনারায়ণের সেরা বিজ্ঞাপন। সপ্তমী-অষ্টমীতে শ্যামবাজার পাড়ার থিয়েটারের সোনালি দিন ফুরিয়েছে, কিন্তু সেই তেলেভাজা-তীর্থের ব্যাটিং অটুট। উল্টো দিকে গোয়াবাগানের পুজো, সামান্য এগিয়ে কাশী বোস লেন ও বিডন স্ট্রিট। একটু পিছিয়ে হাতিবাগান সর্বজনীন। নর্থের এ সব খানদানি পুজোর সঙ্গে পাল্লায় পিছিয়ে নেই লক্ষ্মীনারায়ণ।
টক-ঝাল-মিষ্টি কাশ্মীরি, আমের চপ বা পনির-সয়াবিন-নারকোলের চপ তো সে-দিনের সৃষ্টি। কিন্তু মেগাসাইজ পেঁয়াজি বা স্পেশাল দানা ফুলুরি জ্যান্ত মিথ। ফুলুরির জন্য বেসনটা নিজেরা ভাঙিয়ে রেডি করে ১০০ ছুঁই ছুঁই প্রতিষ্ঠান। ডিপফ্রায়েড বোমা নয়, হিং, কালোজিরে, মৌরি, জোয়ানাদির তুকতাকে তেলেভাজা এখানে শিল্পকীর্তি।
বেঙ্গল হোটেলের ফিশফ্রাই ***
বেহালা নূতন দলের ‘ভুবনডাঙার রাজবাড়ি’র ‘এক্সিট-গেট’ থেকে তিন মিনিটের হাঁটাপথ। ডায়মন্ডহারবার রোডের ও পারে ১৪ নং বাসস্ট্যান্ডের এই পুরনো ঠেকে না-ঢুকলে পুজোয় বেহালা-ট্যুরে ফাঁক থেকে যাবে। হরিদেবপুর থেকে সখেরবাজারে বড়িশা ক্লাব দেখে নূতন দল হয়ে এখানে আসুন। নর্থের ‘কটলেট-কালচার’-কে বেহালার জবাব এই বেঙ্গল। পাড়ার আদরের ডাক বড়দা-র হোটেল। ফিশ ফ্রাই, বাটার ফ্রাই (ব্যাটার) ছাড়া কষা মাংস-ফ্রায়েড রাইসও বিখ্যাত। শীতে না কি নিউমার্কেট থেকে কেনা স্যামনেরও ওরা ফ্রাই খাওয়ান। পুজোয় ভিড় সামলাতে প্রতি বার বেঙ্গলকে পাশেই একটা বাড়তি কাউন্টার খাড়া করতে হয়। ধুলো-ধোঁওয়ায় ঘোরার ক্লান্তিতে হাল্কা কিছু খুঁজছেন? পাঁউরুটিযোগে এমন চিকেন-মাটন স্টু পেলে বর্তে যাবেন। হাল্কা কিন্তু স্বাদে আপস নেই। খ্যাঁটনের পরে পাশে দেবদারু ফটক বা কাছেই বেহালা ক্লাব-মুকুল সংঘ দেখা যায়! এর পরে কি খিদিরপুরের দিকে যাবেন? না কি পিছিয়ে রায়বাহাদুর রোড ধরে সুরুচি। ভাবা প্র্যাকটিস করুন।
পুনঃ— বড় পুজোর কাছাকাছি অবস্থান, স্বাদ এবং কতটা দুর্লভ তার ভিত্তিতে স্টার রেটিং করা হয়েছে।

গোলবাড়ির কষা *****
বাগবাজারের ডাকের সাজের মা-দুগ্গা যেমন, এই স্বাদও ক্লিশে হয়েও ক্লিশে হয় না। বাগবাজারে লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখতে যা হ্যাপা, শ্যামবাজারের মোড় অবধি উজিয়ে সংগ্রাম করে এই কষার টেবিলে পৌঁছনোর ঝক্কিও কম নয়। নর্থে বাগবাজার, টালা বারোয়ারি বা নলিন সরকার স্ট্রিট যেখানেই যান, সে মনে আসবেই। খালি খেতে বসে যুদ্ধজয়ের উত্তেজনায় কঠিন মাংস টেনে ছিঁড়তে বাঁধানো দাঁতকে ভুলবেন না। আর প্যাক করে বাড়ি নিয়ে গেলে এ মাংসের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী তেঁতুল-টকের চাট না-দিলে কাউন্টারে জোর ঝগড়া করবেন। কষা বহু, গোলবাড়ি একটাই। এসি-বিহীন দেড়খানা ঘরে ঘামতে ঘামতে মাংসের সঙ্গে কুস্তির পরে যা তৃপ্তি তা যে খেয়েছে, সে জানে! ডেনমার্কের রাজপুত্তুরকে বাদ দিয়ে হ্যামলেটের অভিনয়ের মতোই গোলবাড়ির কষা বিনা কলকাতার স্ট্রিট ফুড নিয়ে আলোচনা অসম্ভব। কথা বাড়ানোর দরকার নেই। উনিশ শতকের মনীষিকুল, মিটিং-মিছিল-ধর্মঘট আর শরতের সাদা মেঘের মত এই গরগরে মাংসও আমাদের নির্মাণে মিশে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.