‘ভূতের বাড়ি’ তৈরির আয়োজনে নেমেছেন ১৪ থেকে ৮৬ বছর বয়সীরা। তাঁদের আয়োজনে ডোমজুড়ের মহিয়াড়ি তালপুকুরধার সর্বজনীন দুর্গাপুজোর এ বারের থিম ‘পোড়ো বাড়িতে ভূতের আড্ডা’। আঠারো জন কারিগর গত এক মাস ধরে তিল তিল গড়ে তুলছেন হাড়ে হিম ধরানো পরিবেশ। তৃতীয়ার আগেই মণ্ডপ তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে উদ্যোক্তাদের দাবি। এ বার এই পুজো পড়ল ৫৮ বছরে।
পুজো গড়ে ওঠার ইতিহাসের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে এক প্রতিবাদের চিত্র। প্রবীণ মানুষেরা জানালেন, স্থানীয় জমিদারদের একটি সাত বিঘা আয়তনের পুকুর রয়েছে এখানে। সে কারণে এলাকাটিকে বলা হত তালপুকুরধার। এক সময়ে এখানে যাঁরা বসবাস করতেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ফলে এই এলাকায় কোনও দুর্গাপুজোও হত না।
কিন্তু পুজোর উচ্ছাস থেকে তো আর দূরে থাকা যায় না। ফলে এলাকার মানুষজন কিছুটা দূরে যেতেন পুজো দেখতে। তাঁদের অভিমান, মলিন বেশভূষা সম্বলিত তালপুকুরধার এলাকার গরিব-গুর্বো মানুষগুলিকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতেন না ওই সব পুজো কমিটির সর্বেসর্বারা। হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠার উপায় বের করলেন তালপুকুরধার এলাকার তৎকালীন কয়েকজন যুবক। নিজেরাই চালু করে দিলেন পুজো। চেয়েচিন্তে ত্রিপল, বাঁশ জোগাড় করে এনে বানানো হল মণ্ডপ। তৈরি হল টিনের চালের দুর্গামণ্ডপ। ৫৭ বছর আগের সেই আয়োজন দিনের পর দিন কলেবরে বেড়েছে। এলাকার দারিদ্র্যও যেমন ঘুচেছে, মাটির বাড়ির জায়গায় মাথা তুলেছে একের পর এক পাকাবাড়ি, পুজোর বৈভবও বেড়েছে তাল মিলিয়ে। তৈরি হয়েছে পাকা স্থায়ী দুর্গামন্দির। গত কয়েক বছর ধরে মণ্ডপ ও আলোকসজ্জার দিক দিয়ে ডোমজুড়ের অন্যতম সেরা পুজোর স্বীকৃতি পেয়ে আসছে মহিয়াড়ি তালপুকুরধার সর্বজনীন দুর্গাপুজো।
এখনও পুজোর আনন্দ সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাঁদা তুলতে নামেন শান্তিময় স্বর্ণকারের মতো ৭৫ বছরের বৃদ্ধ। অবসরপ্রাপ্ত রেলের এই কর্মচারী বললেন, “আমি গিয়ে দাঁড়ালে না বলতে পারেন না বাসিন্দারা। তাঁরা নিজের ইচ্ছায় যা দেন তাই-ই সানন্দে গ্রহণ করি।” পুজোর চার দিন ব্রাহ্মণকে পুজোর জোগাড়যন্তর করে দেওয়ার কাজটিও টানা করে থাকেন শান্তিময়বাবু। বাড়িতে বসে থাকতে পারেন না ৮৬ বছরের মিলন গিরি। পুজোর সময়ে মণ্ডপে হাজির হয়ে সকলকে উৎসাহ দেন তিনি।
শুভঙ্কর মজুমদার, প্রকৃতি মুখোপাধ্যায়ের মতো যুবকেরা যদিও সিংহভাগ কাজ করেন। তবুও প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা আপোষহীন। রয়েছে চোদ্দো বছরের সৌরভ তেওয়ারি। পুজোর আয়োজনে তার উৎসাহ দেখার মতো। সকলের মিলিত এই উদ্যোগকে সম্বল করে তালপুকুরধার সার্বজনীন প্রস্তুত হচ্ছে দর্শনার্থীদের এক অন্য জগতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ২০০০ বর্গফুটের মণ্ডপে থাকছে চারটি স্তর। প্রতিটি স্তরে থাকছে ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা। কী নেই সেখানে? নরকঙ্কাল, মানুষের কাটা হাত, পা, কৃত্রিম গাছে ঝোড়োবাতাস, ফিস ফিস করে রহস্যময় কথাবার্তা আর আলো-আঁধারির খেলা। সামঞ্জস্য রেখে আলোর কারসাজি, ডিজিটাল সাউন্ড। এই থিমের রূপকার শিল্পকলার স্নাতক প্রাণেশচন্দ্র দাস বললেন, “মণ্ডপে ঢোকা থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত এক অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পাবেন দর্শকেরা।” চারটি স্তর পেরিয়ে তবেই দর্শকেরা পৌঁছতে পারবেন দুর্গাপ্রতিমার কাছ পর্যন্ত। ডোমজুড়ের ‘কুমারটুলি’ নামে পরিচিত প্রসস্থ থেকেই এসেছে প্রতিমা। উদ্যোক্তাদের দাবি, দর্শনার্থীদের সব ভয় কেটে যাবে মায়ের সদাহাস্য প্রশান্ত মূর্তির সামনে দাঁড়ালে। |