এ যেন জামশেদপুরের ম্যাডক্স স্কোয়ার!
দুপুরের এলাহি ভোগের ঢেঁকুর বন্ধ হওয়ার আগেই আমবাগানের মাঠটায় বাসি কাগজ পেতে সার-সার ‘সত্যাগ্রহী’-র মতো বডি ফেলে দিয়েছে এক-একটি পরিবার। তফাত একটাই। এই অবস্থানে অন্তহীন আড্ডার টাকনা হিসেবে টপাটপ চাট থেকে চাউমিন, রোল থেকে রেজালা সাঁটানোর উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। সাকচির কালিমাটি রোডের দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ই বলুন, বা কাশিডির সঞ্জীব দালালের পরিবার, এই চারটে দিন বাড়িতে কঠোর ভাবে ‘অরন্ধন’-এর আচার মানেন। মাঠে বসে সন্ধে গড়িয়ে কখন রাত হয় বুঝতেই পারেন না ওঁরা। পরিবারের ‘সিনিয়র সিটিজেন’-রা ১২টা বাজতেই উঠে পড়লেও বাকিদের জন্য রাত তখনও তরুণী। আমবাগানে জামশেদপুর সর্বজনীন ওরফে বেঙ্গল ক্লাবের পুজোয় ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় রাত কাবার।
টেলকোর সবুজকল্যাণ সঙ্ঘের মাঠেও ছবিটা আলাদা নয়। কলকাতার গিন্নি শিউলি মিত্র পুজোর একটা সন্ধেও বাপের বাড়ির শহরের প্রিয় মাঠটি ছেড়ে থাকবেন না। টেলকোর শিক্ষানিকেতন স্কুলে তাঁর সহপাঠী রূপক ভট্টাচার্য এখন মাসকাট- প্রবাসী। শুভ্রাংশু ভৌমিক নাইজিরিয়ায়, নীলাঞ্জন সেন-অজয় চক্রবর্তীরা চাকরিসূত্রে লখনউবাসী। আর এক বন্ধু অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জামশেদপুরেই থিতু। পুজো মানে মাঝরাত্তির পুইয়ে খোলা মাঠে এই স্কুল-সতীর্থদের ‘রি-ইউনিয়ন’। বর্ধমানের কারিগরের মোগলাই পরোটা-কবিরাজি কাটলেটে আড্ডাটা আরও জমে ওঠে।
ইস্পাত-নগরীর এই দু’টো মাঠেই রাতভর লাখো লোকের সমাবেশ। বেঙ্গল ক্লাবের এক পুজোকর্তা তপন দাস হাসছিলেন, “রোজ সকালে মাঠ থেকে চার-পাঁচ বস্তা খবরের কাগজ সাফ করা হয়।”
আড্ডা ও ভোজ-সংস্কৃতিতে রাঁচি-ই বা কম কিসে? ম্যাডক্স স্কোয়ার-মার্কা মাঠ নেই তো থোড়াই কেয়ার! মেকনের পুজোর প্রকাণ্ড হলটায় গিজগিজে ভিড় এবং আ-মরি বাংলা ভাষার কলতানে চোখ বুজলে বাগবাজার কি যোধপুর পার্ক বোধ হয়। এইচইসি টাউনশিপের সেক্টর টু-র পুজোয় অত রাতে সন্ধিপুজোর লুচি-পায়েস সেবাতেও ভিড় উপচে পড়ে। বর্ধমান কম্পাউন্ডের হরিমতী কালী মন্দিরের পুজোয় ভোগের কুপনের বালাই নেই। সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী, তিন দিনই সবার অবারিত দ্বার। ১০০ ছুঁই ছুঁই হিনু সর্বজনীনের পুজোয় শুধু অষ্টমীতেই পাহাড়-প্রমাণ সাত কুইন্টাল চালের ভোগ রান্নার আয়োজন। রাঁচির হরিমতী মন্দির-হিনু-দেশপ্রিয় পার্কে খিচুড়ি-লাবড়ার সঙ্গে আদি যুগ থেকে বিহারের হরি পাঁড়ে-দেওকি পাঁড়েরা জড়িয়ে থাকলেও, জামশেদপুরে উৎকলীয় ব্রাহ্মণদের জয়জয়কার। বেঙ্গল ক্লাবের ভোগে চেনা মেনুতে তরকারির বৈচিত্র্য বিশেষ আকর্ষণ জিইয়ে রাখে। কিন্তু নর্দান টাউন অ্যান্ড সার্কিট হাউস এরিয়ার ভোগের মহার্ঘ কুপন হল, পুজোয় ‘লটারির টিকিট’। নিখাদ নিরামিষ বাঙালি মেনু কাকে বলে, তা ওঁরা দেখাচ্ছেন বটে! ভোগে খিচুড়ি-লাবড়া-পায়েস তো থাকবেই, সঙ্গে হয়তো ছানার ডালনা কি আলু-পটল বা ধোকা। মিষ্টিতে পায়েসের সঙ্গে দরবেশ, অমৃতি বা কমলাভোগ। উত্তর ভারত-প্রভাবিত লাড্ডু নয়, খাঁটি দরবেশ। চাটনিতেও টমেটো-আমসত্ত্ব, আনারস বা প্লাস্টিকের বৈচিত্র্য। রাধারমণ মহাপাত্র বা রাধুর রান্না লোকে গোগ্রাসে খায়।
রাঁচির বহু পরিবারই আগে-ভাগে ঘোষপাড়া, দেশপ্রিয় পার্ক বা রামকৃষ্ণ মিশনের ভোগের কথা মাথায় রেখে নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট ছকে রাখেন। পুজোর দুপুরের এই স্বাদু নিরামিষের জন্য আকুতি দেখে বর্ধমান কম্পাউন্ডের সুবীর লাহিড়ি ঠাট্টা করেন, “ভেজের লাইনটা এত বড় হলে, নন-ভেজে না জানি কী হত!” |