চেনা শহরের এক অচেনা রূপ। কোথাও খাস শহরের বুকে উঠে এসেছে এক টুকরো গ্রাম। কোথাও শান্তিনিকেতন। কোনও মণ্ডপের থিমে শোনা যাচ্ছে পৌরাণিক কাহিনী।
গড়িয়ার ‘ইস্ট বালিয়া সর্বজনীনে’র মণ্ডপে ধামসা, মাদলের শব্দে মন চলে যাবে দূরের কোনও সাঁওতাল গ্রামে। আল্পনা আঁকা মাটির দোতলা বাড়ি, ছোট্ট ধানখেত, ধানের গোলায় সাজছে গ্রাম। বোলপুর থেকে আসছে সাঁওতালদের একটি দল। আগুন লাল কাপড়ে এলোকেশী দেবীর গয়না বলতে কাঠের মালা আর শাঁখা-পলা।
কল্পনায় লালন ফকিরের আখড়া ‘আরশিনগর’। প্রায় দশ মাসের পরিশ্রমে ২০০ কাঠা জমিতে বট, আম, ঢ্যাঁড়স, কামরাঙা, নারকেল, সুপারি, সবেদা, ডালিমের মতো বিভিন্ন গাছের চাষ হচ্ছে। পুকুর, গোশালা, বটগাছের নীচে ‘আদি পশুপতি’, নদীর পারে নৌকো, বাঁশির সুরে শহুরে ধূসর মনে শান্তির স্পর্শ সবই মিলবে এখানে, বলছেন ‘বেহালা বুড়োশিবতলা জনকল্যাণ সঙ্ঘে’র উদ্যোক্তরা। খড়ের চালার মণ্ডপে দেবীর আঁচল এখানে প্রতিটি সন্তানের মাথায়।
খড় দিয়ে ষড়ভুজাকৃতির নাটমন্দির, ‘ছাতিমতলা’, ‘ব্ল্যাক হাউস’, ‘শ্যামলী’, ‘চৈতি’ শালবন সবেরই দেখা মিলবে দমদম পার্কের ‘নবারুণ অ্যাথলেটিক ক্লাবে’র পুজোয়। আলো-শব্দের খেলায় সাজছে শালবন। গড়ে উঠেছে ২৫০ প্রজাপতির খেলা, ছ’ফুটের দীর্ঘ বুদ্ধমূর্তি, সহজপাঠের পাতা থেকে তুলে আনা ছবির রিলিফ ওয়ার্কের শান্তিনিকেতন। বিশ্বশান্তির দূত রবীন্দ্রনাথ এই পুজোর মূল বিষয়। |
এ বার মায়ের গজে আগমন, দোলায় গমন। দর্শকদের তারই গল্প বলছে ‘৬৬ পল্লী সর্বজনীন’। গোটা ষাটেক সৈন্যসামন্ত, আর হাতি থাকছে মণ্ডপে। তবে সবটাই পাটের। মাতৃমন্দির পাল্কির অনুকরণে। উল্টো দিকের দেওয়ালে পাটের কাজে দুর্গার ন’টি রূপ। দুর্গের ধাঁচে মণ্ডপের প্রবেশপথে দামামা বাজবে, জ্বলবে মশাল। তবে মায়ের দশহাত এখানে প্রস্তুত বরাভয়ের জন্য।
কড়ি আর কাচে বাংলার মন্দির গড়ছে কুঁদঘাটের ‘পুঁটিয়ারি সর্বজনীন’। সিলিংয়ে কড়ির ফ্রেমিংয়ে বসানো গ্লাস পেন্টিং ব্যবহার হবে ঝাড়বাতির জন্য। একচালা প্রতিমার চালচিত্র ও গয়নাতেও ব্যবহার হচ্ছে কড়ি। ‘বেলগাছিয়া যুব সম্মিলনী’র মণ্ডপে ঢুকলে পৌঁছে যাওয়া যাবে সাদা-কালো ছকের রাজ্যে। এ বারের থিম ‘দাবার দেশে’। দাবার বোর্ডের ফ্লেক্সে ঢাকছে মণ্ডপ। প্রবেশপথ থেকে মূল মণ্ডপের পথে গ্লোসাইন বোর্ডে ভেসে উঠবে দাবার জন্মবৃত্তান্ত, বিশ্ব দরবারে দাবার বিস্তার, দাবার ঘুঁটি ও দাবা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি ইতিহাস।
আলিপুর রোডের ‘কোলাহল গোষ্ঠী’র মণ্ডপ আটচালার অনুকরণে। তির কাঠি, পাট কাঠি, চোলি কাপড়ের মতো ‘দশকর্মা’র উপকরণে সাজানো হচ্ছে মণ্ডপ। মাটির প্রদীপে তৈরি হচ্ছে বিশাল পদ্মফুল।
কাঠের পুতুল তৈরিতে বিখ্যাত বর্ধমানের নতুনগ্রাম। লুপ্তপ্রায় এই শিল্পে সাজবে ‘লেকটাউন গ্রিন পার্কের বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবে’র পুজো। ‘দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘে’ এ বছরের থিম ‘সুরে তালে বাজি, উৎসবে সাজি’। নাটমন্দিরের মণ্ডপে বাঁশের বাঁশি, পিতলের ছোট-বড় মন্দিরায় তৈরি হয়েছে ময়ূর, শঙ্খ, স্বস্তিকা, সূর্য আর দুর্গার মুখ। মণ্ডপে শোনা যাবে গায়ত্রী মন্ত্র, মন্দিরার টুংটাং আর বাঁশির সুর।
বারুইপুরের ‘পালপাড়া সর্বজনীনে’র মণ্ডপ হচ্ছে টেরাকোটার রঙের। থাকবে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বয়সের ছবি আর পাণ্ডুলিপি। রঙ-বেরঙের ফিতেয় রঙিন ‘সংগ্রামী’ পরিচালিত ‘বি আর এস-৩ সর্বজনীন’। ফিতে দিয়ে তৈরি হচ্ছে ছোট-বড় অসংখ্য পুতুল। তাতেই সাজবে মণ্ডপ।
নেপালের রাজপ্রাসাদের অনুকরণে হচ্ছে ভবানীপুরের ‘রায় স্ট্রীট সর্বজনীনে’র মণ্ডপ। ভিতরের দেওয়ালে চন্দন রং কাঠের গুঁড়োয় চিত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন প্যানেল। তাতে কামার, কুমোর, সাফাইকর্মীদের মতো অনগ্রসর সমাজবন্ধুদের জীবনসংগ্রাম।
পুরাকালের রাজা সত্রাজিতের উপাসনায় সন্তুষ্ট সূর্য তাঁকে দেন ‘স্যমন্তক মণি’। সম্পদের প্রতীক ‘স্যমন্তক’ আবার লোভ, হিংসা আর কামনার প্রতীকও। পুরাকালের ‘স্যমন্তক’ থেকে মুঘল গৌরবের ‘কোহিনূর’, কিংবা আফগানিস্তানের সন্ত্রাসে ধ্বংস হওয়া বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি কাল্পনিক কালচক্রে সবই উঠে আসবে পূর্ব কলকাতার ‘পল্লিশ্রী সর্বজনীনে’র’ মণ্ডপসজ্জায়। এর জন্য ব্যবহার হচ্ছে ভাঙা চাকা ও অন্যান্য শিল্পবর্জ্য। উদ্যোক্তাদের দাবি, দর্শকরা মণ্ডপে ঢুকলে সময়ের চাকায় চড়ে চলে যাবেন কল্পনার সফরে। |